পরিবার
পরিবার একটি মৌলিক ও স্বাভাবিক ক্ষুদ্রতম গোষ্ঠী। সাধারণতঃ পরিবার বলতে স্থায়ী সম্বন্ধে আবদ্ধ একটি পুরুষ, একটি নারী ও তাদের সন্তানাদিকে বুঝায়। পরিবার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক গোষ্ঠী। কোন কোন ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরূপে স্বামী স্ত্রী ছাড়াও তাদের বৃদ্ধ পিতা-মাতা ও নিকট আত্মীয়ও থাকেন। আগেকার দিনে পরিবারের ভৃত্যও পরিবারের সদস্যরূপে গণ্য হত। ল্যাটিন শব্দ famulus (যার অর্থ family) কথাটির প্রকৃত অর্থ ভৃত্য। পরিবার একক (nuclear family) বা যৌথ পরিবার (joint family) হতে পারে। আগে আমাদের দেশে যৌথ পরিবার (joint or extended family) খুবই প্রচলিত ছিল, কিন্তু অর্থনৈতিক কারণে এই ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে এবং প্রায় সর্বত্রই একক পরিবার দেখা যাচ্ছে। পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল সদস্যদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সন্তানাদি উৎপাদনের জন্য ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ। এই ঘনিষ্ঠতাই পরিবারের মূল ভিত্তি। কিন্তু পাশ্চাত্য দেশে আজকাল আবার one parent family’ও দেখা যাচ্ছে।
কাইভার পরিবারের কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন—–
- সহবাসের সম্পর্ক,
- বিবাহ প্রথার মাধ্যমে এই সহবাসের সম্পর্ক সুপ্রতিষ্ঠিত ও রক্ষিত করা,
- বংশের সদস্যদের নামকরণ পদ্ধতি,
- সন্তান প্রতিপালনের জন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
- একটি সাধারণ বাসস্থান।
পরিবারের বৈশিষ্ট্য—–
সার্বিকতা (Universality)—সহস্র সহস্র বৎসর ধরে মানুষের সমাজে পরিবারের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। এমন কোন সমাজব্যবস্থা নেই যেখানে পরিবার প্রথা নেই।
সীমিত ভিত্তি—
পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভালবাসা, স্নেহ মমতা প্রভৃতি থাকার জন্য তাদের মধ্যে বন্ধন সুদৃঢ় হয়।
সীমিত রূপ—
সাধারণতঃ একক পরিবারের আকৃতি অর্থাৎ সদস্য সংখ্যা সীমিত। যৌথ পরিবারে অবশ্য বেশ কিছু সদস্য একসাথে থাকে।
গঠনমূলক প্রভাব—
শিশুর সর্বাঙ্গীন বিকাশ সাধনের শ্রেষ্ঠ স্থান পরিবার। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পিতা মাতার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশী। অন্যান্য সদস্যগণ শিশুর শিক্ষা ও প্রতিপালনে বিশেষ অংশগ্রহণ করে।
সামাজিক গঠনের মূল কেন্দ্র—–
পরিবার যেন সমাজের কোষ (cell)। অসংখ্য কোষ নিয়ে যেমন জীবদেহ গঠিত হয় তেমনি অসংখ্য পরিবার নিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজ গঠিত হয়।
পারিবারিক দায়িত্ব—–
পরিবারের সদস্যদের প্রধান দায়িত্ব হল শিশুর বিকাশ সাধনে সাহায্য করা। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে স্নেহ ভালবাসা থাকার জন্য প্রত্যেকেই সানন্দে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে। এই স্নেহ ভালবাসা নষ্ট হয়ে গেলে পারিবারিক বন্ধনও নষ্ট হয় এবং পরিবার নষ্ট হয়ে যায় — এই দৃশ্য আজ আমরা বিশেষ করে পাশ্চাত্য জগতে দেখছি এবং আমাদের দেশেও এই দৃশ্য ঘটতে দেখছি।
সামাজিক বিধিনিষেধ—
পরিবারে মানুষকে থাকতে গেলে অনেক স্বার্থত্যাগ করতে হয়। বহু সামাজিক বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হয়, খেয়াল খুশীমত কাজ করা সম্ভব নয়। এরকম স্বার্থপরের মত আচরণ করল পরিবার ভেঙে পড়ে ও শিশুসন্তানেরা বিশেষ কষ্টের পড়ে।
পরিবারের অন্যতম মূল ভিত্তি যৌন সম্বন্ধ হলেও এই যৌন প্রবৃত্তিকে সংযত করা প্রয়োজন। এই যৌন আকাঙ্খা অতিমাত্রায় প্রকট হলে পারিবারিক ব্যবস্থা ভেঙে যেতে পারে। এর পরিবর্তে একান্ত প্রয়োজন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আধ্যাত্মিক একাত্মতা। সমাজে জৈবিক প্রয়োজন ছাড়া আরও অন্যান্য উচ্চতর পর্যায়ের প্রয়োজন সাধিত হয়, যথা শিশুপালন, এটি ভুললে চলবে না। এই শিশুই হল পরিবারের কেন্দ্র। এছাড়া পরিবারের মধ্যে সদস্যগণ বিপদে আপদে সাহায্য পান, অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার ব্যবস্থা ও ভরণপোষণের ভার অন্য সদস্যদের মাধ্যমে সাধিত হয়। অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ ছাড়াও পরিবার সদস্যদের সূক্ষ্ম মানসিক প্রবণতাকে প্রকাশ পেতে—যথা, গান, বাজনা, সাহিত্যচর্চা—সাহায্য করে ও উপযুক্ত পরিবেশ জোগায়। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে পরিবার রূপ সামাজিক সংগঠনের বিকল্প নেই।
পরিবার প্রথা কবে থেকে মনুষ্য সমাজে প্রচলিত হয়েছে তা বলা অসম্ভব। কিন্তু আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, যবে থেকে পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব হয়েছে পরিবার প্রথাও ততদিন আছে যদিও আইনগত অর্থে পরিবার তখন ছিল না। পশুজগতেও আমরা দেখি যে শিশু সন্তান পালনের জন্য পিতা-মাতাকে একস্থানে বেশকিছু দিন থাকতে হয়। মানুষের ক্ষেত্রে এটি আরও সত্য কারণ জীবনের প্রথম পাঁচটি বছর প্রায় অসহায়। পরিবার প্রথা না থাকলে মানবশিশুর লালন পালন সম্ভব হত না এবং মানবসমাজ ধ্বংস হয়ে যেত।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .