বাংলায় পঞ্চাশের মন্বন্তরের কারণ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজ সরকারের তীব্র অর্থনৈতিক শােষণে অবিভক্ত বাংলায় ১৯৪৩ সালে (১৩৫০ বঙ্গাব্দ) এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। এই মন্বন্তর বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করে। এর বিভিন্ন কারণ ছিল-
খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়া
১৯৪০-৪১ সালে বাংলায় সীমিত আকারে খাদ্য সংকটে গরিবের সঞ্চয় ফুরিয়ে যায়। ১৯৪২-এর অক্টোবরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে ধানের ফলন কমে যায়। মারা যায় প্রায় দু’লক্ষ গবাদি পশু। মানুষের সঞ্চিত খাদ্য শেষ হয়ে যাওয়ায় ১৯৪৩ সালে দেখা দেয় মন্বন্তর।
খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত
১৯৪২-এর বন্যায় গ্রামীণ রাস্তাগুলি ভেঙে যােগাযােগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়। ফলে দূর দূরান্তে খাদ্যশস্য পাঠানােয় অসুবিধা দেখা দেয়।
বার্মা থেকে চাল আমদানি ব্যাহত
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে বার্মা থেকে কলকাতা তথা বাংলায় চাল আসত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান বার্মা দখল করে নেওয়ায় চাল আমদানি বন্ধ হয়ে যায়।
জাপানি আক্রমণের আশঙ্কা
জাপান যে কোনাে সময় বাংলা হয়ে ব্রিটিশ ভারতে আক্রমণ করতে পারে, এই আশঙ্কা করেছিল ব্রিটিশ সরকার। এজন্য পােড়ামাটির নীতি অনুসারে বার্মার নিকটস্থ চট্টগ্রাম ছেড়ে আসার সময় সেখানকার নৌকা, মােটর যান, গােরুর গাড়ি প্রভৃতি ভেঙে যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ফলে বাংলার সীমান্তে খাদ্য সরবরাহ অসম্ভব হয়ে পড়ে।
চার্চিলের ভূমিকা
বাংলায় খাদ্যাভাবের সময় অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা জাহাজে করে বাংলায় খাদ্যশস্য পাঠাতে চেয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধের জন্য জাহাজ লাগবে এই যুক্তিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল কোনাে জাহাজ দিতে রাজি হননি।
সেনার জন্য খাদ্য রপ্তানি
বাংলায় খাদ্যভাবের মধ্যেই ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধের সময় সেনাদের চাহিদা মেটাতে প্রয়ােজনের অতিরিক্ত খাদ্যশস্য বাইরে পাঠায়। এতে বহু খাদ্য অপচয় হয়। বেড়ে যায় খাদ্যসংকট।
বাণিজ্য গণ্ডি
১৯৪২ সালে ব্রিটিশ সরকার ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে বাণিজ্য গণ্ডি চালু করে। ফলে ব্যবসায়ীরা অন্য প্রদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করতে পারেনি।
মজুতদারি
জাপানের আক্রমণের আশঙ্কায় ইংরেজ সরকার বাংলা থেকে প্রচুর পরিমাণ চাল মজুত করে। দুর্ভিক্ষের পরে ৯০ হাজার টন চাল নষ্ট হয়েছিল। খাদ্য সংকটের আশঙ্কায় অনেক ব্যবসায়ী চাল কিনে গুদামে মজুত করে এবং দুর্ভিক্ষের সময় চড়া দামে বিক্রি করে।
সংকটকে উপেক্ষা
বাংলায় খাদ্য সংকট শুরু হলে তা মােকাবিলায় তৎপর হয়নি ব্রিটিশ সরকার। মৃত্যু-মিছিল শুরু হলেও ত্রাণকার্য হয়েছে ধীর গতিতে।
পঞ্চাশের মন্বন্তরের ভারতীয় অর্থনীতি ও শিল্প-সাহিত্যে প্রভাব
অর্থনৈতিক প্রভাব ও মন্বন্তরের সময় বাংলায় চূড়ান্ত অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসে। দরিদ্র মানুষের দীর্ঘদিন ধরে জমানাে অর্থসম্পদ দুর্ভিক্ষের সময় খাদ্য কিনতে গিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। এরপর নিঃস্ব, রিক্ত, অভুক্ত মানুষগুলি থালা-বাটি হাতে রাস্তায় ভিক্ষাবৃত্তিতে বেরিয়ে পড়ে। “মা, একটু ফ্যান দাও” বলে কাতরাতে কাতরাতে কলকাতার বুভুক্ষু মানুষের দল দিশাহীনভাবে ঘুরে বেরাচ্ছে এবং পরে অভুক্ত, শীর্ণ, কঙ্কালসার এই মানুষগুলি রাস্তার ধারে মরে পড়ে থাকছে – এই দৃশ্য কলকাতা সহ বাংলার সর্বত্র দেখা যেত।
শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি
পঞ্চাশের মন্বন্তরের পটভূমিকায় ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিভিন্ন সাহিত্য ও শিল্প সৃষ্টি হয়েছে। চিত্তপ্রসাদ তার ক্ষুধার্ত বাংলা : ১৯৪৩-এর নভেম্বরে মেদিনীপুর জেলায় ভ্রমণ’-এ, বিজন ভট্টাচার্য তাঁর নবান্ন’ নাটকে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার অশনি সংকেত’ উপন্যাসে পঞ্চাশের মন্বন্তরের ভয়াবহ কাহিনি তুলে ধরেন। এছাড়া অমলেন্দু চক্রবর্তীর ‘আকালের সন্ধানে’, কে.এ আব্বাস পরিচালিত ‘ধরতি কে লাল’ এবং বিমল রায় পরিচালিত চলচ্চিত্র, জয়নুল আবেদিনের আঁকা বিভিন্ন চিত্র প্রভৃতিতে পাশের মন্বন্তরের করুণ কাহিনি ধরা পড়েছে।
পঞ্চাশের মন্বন্তরের ফলাফল
বাংলায় পঞ্চাশের মন্বন্তরের বিভিন্ন ফলাফল দেখা যায়-
ব্যাপক প্রাণহানি
মন্বন্তরে মৃতের সংখ্যা ব্রিটিশ সরকার ইচ্ছা করেই প্রকাশ করেনি। দুর্ভিক্ষে অন্তত ৪০-৭০ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল বলে অনুমান। মৃতদেহ সৎকারের লােক ছিল না। মৃতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মৃত মানুষের মাংসে শকুন, শিয়াল কুকুরেরও অরুচি ধরে।
অর্থনৈতিক বিপর্যয়
মন্বন্তরে বাংলায় ঘটে যায় চূড়ান্ত অর্থনৈতিক বিপর্যয়। সর্বস্বান্ত মানুষকে দুর্ভিক্ষের সময় থালা-বাটি হাতে রাস্তায় ভিক্ষা করতে দেখা যায়। শেষপর্যন্ত অনাহারে রাস্তার ধারে পড়ে থাকত এদের মৃতদেহ।
মানবিক বিপর্যয়
মন্বন্তরে চূড়ান্ত মানবিক বিপর্যয় দেখা যায়। কুকুরের সঙ্গে লড়াই করে ডাস্টবিন থেকে মানুষ খাদ্য খেতে শুরু করেছিল। মানুষ তার প্রিয়জনকে মৃত্যুদশায় ফেলে রেখে বাঁচার তাগিদে বাড়ি ছাড়ে। অভাবের জ্বালায় অনেকে স্ত্রী-সন্তানকে বিক্রি করে।
কমিশন গঠন
দুর্ভিক্ষের কারণ খুঁজতে সরকার ‘দুর্ভিক্ষ অনুসন্ধান কমিশন গঠন করে। ১৯৪৫ সালে কমিশন রিপাের্ট জমা দেয়। রিপাের্টে সরকারের সার্বিক ব্যর্থতার সমালােচনা করা হয়।
সাহিত্য সৃষ্টি
মন্বন্তরের পটভূমিকায় বিজন ভট্টাচার্য লেখেন নবান্ন’ নাটক। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘অশনি সংকেত উপন্যাসে, চিত্তপ্রসাদ তার ক্ষুধার্ত বাংলা ঃ ১৯৪৩-এর নভেম্বরে মেদিনীপুর জেলায় ভ্রমণ’ ফুটিয়ে তােলেন দুর্ভিক্ষের মর্মস্পর্শী বিবরণ।
চিত্তপ্রসাদের গ্রন্থটি নিষিদ্ধ হয়। ৫০০০ কপি বাজেয়াপ্ত করে সরকার।
মূল্যায়ন
পঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়ে গবেষণা আজও চলছে। এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, এই সময়ের ঘটনা ও তথ্য অনুসরণে পরবর্তীকালে দেশে কোনাে বঙ্কিমচন্দ্র জন্মগ্রহণ করলে হয়তাে আর একটি “আনন্দমঠ’ সৃষ্টি হবে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .