প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সমাজতান্ত্রিক সােভিয়েত ইউনিয়ন বাদে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। যুদ্ধ পরবর্তীকালের জার্মানিতেও রাজতন্ত্রের বিরােধিতা শুরু হয়। ব্যাভেরিয়াসহ অভিন্ন অণ্ডলে গণবিদ্রোহ শুরু হলে সম্রাট কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ম হলান্ডে চলে যান। জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেতা ফ্রেডারিক ইবার্ট-এর পরিচালনায় সসাশ্যালিস্ট রিপাবলিকান দল জার্মানিতে রাজতন্ত্রের পরিবর্তে প্রজাতান্ত্রিক সরকার গঠন করে। যার নাম হয় ভাইমার প্রজাতন্ত্র। এই প্রজাতান্ত্রিক সরকারের আমলে বিভিন্ন কারণে হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসিবাদের উন্মেষ ঘটে।
নাৎসিবাদের উন্মেষের প্রেক্ষাপট
ভাইমার প্রজাতন্ত্রের ব্যর্থতা
ভাইমার প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ে। এই সরকার ভার্সাই চুক্তির অপমানজনক শর্তগুলি মেনে নিলে এবং ৬৬০ কোটি পাউন্ড ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হলে জার্মানবাসী এই সরকারের প্রতি ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ফলে ভাইমার প্রজাতন্ত্র জনপ্রিয়তা হারায়। এই পরিস্থিতিতে হিটলারের নাৎসি দলের উত্থানের পথ প্রশস্ত হয়।
আর্থিক সংকট
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত জার্মানি আর্থিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে। মুদ্রাস্ফীতি ও নিত্য প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধিতে জার্মানবাসীর আর্থিক জীবন একেবারে ভেঙে পড়ে। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মহামন্দা দেখা দিলে ইউরােপের অন্যান্য দেশের মতাে জার্মানিও মার্কিন পুঁজির লগ্নির আশা করে। কিন্তু মার্কিন পুঁজিপতিরা ইউরােপে অর্থলগ্নী করতে অস্বীকার করলে জার্মানির অর্থসংকট আরও তীব্র হয়। পশ্চিমি শক্তিবর্গ ডাওয়েজ ও ইয়ং পরিকল্পনার মাধ্যমে জার্মানবাসীর অর্থসংকট মেটাতে চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভূমিকা
ভাইমার প্রজাতন্ত্রে রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য কোনাে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা স্থায়ী হয়নি। সােশ্যাল ডেমােক্র্যাট-সেন্টার ডেমােক্রাটদের নিয়ে গঠিত যৌথ মন্ত্রীসভা স্থায়ী হয়নি। ১৯১৯-১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জার্মানিতে মােট ১৫টি মন্ত্রীসভা ক্ষমতায় আসে। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর বিশিষ্ট জার্মান রাজনীতিবিদ তথা বিদেশমন্ত্রী স্ট্রেসম্যান মারা যাওয়ার পর জার্মান রাজনীতি পুনরায় সংকটগ্রস্থ হয়ে পড়ে। এই সংকটের সুযােগ নেয় হিটলার ও তার নাৎসি দল।।
জার্মান বিদেশ নীতির ব্যর্থতা
জার্মান সাধারণতন্ত্রী সরকারের বিদেশনীতির উদ্দেশ্য ছিল সামরিক ক্ষেত্রে জার্মানির স্বাধীনতা পুন-প্রতিষ্ঠিত করা, রাইন অঞ্জলকে পুনরায় জার্মানির অন্তর্ভুক্ত করা এবং বিদেশিদের কবল থেকে দেশকে রক্ষা করা। কিন্তু যুদ্ধের পর জার্মানি রাশিয়ার সঙ্গে র্যাপােলাে সন্ধিতে আবদ্ধ হলে (১৯২২ খ্রি.) জার্মান বিদেশনীতির উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়, এতে জার্মানবাসী ক্ষুব্ধ হয়।
সংসদীয় গণতন্ত্রে অশ্রদধা
জার্মানির গণতান্ত্রিক সংবিধানের ত্রুটির জন্য গণতন্ত্রের ভীত দুর্বল ছিল, যার জন্য রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা আসেনি। জার্মান জাতির গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সরকার ব্যর্থ হয়, ফলে গরিষ্ঠ সংখ্যক জার্মানবাসী প্রচলিত গণতান্ত্রিক সংসদীয় ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারান। যার পূর্ণ সুযােগ নেয় হিটলারের নাৎসি দল।
কমিউনিস্ট-ভীতি
জার্মানিতে স্পার্টাকান নামক কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে কৃষক-শ্রমিক আন্দোলন এবং বিভিন্ন শিল্প কারখানাগুলিতে ধর্মঘট শুরু হয়। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শিল্পপতিরা পর্যন্ত এতে ভীত হয়ে পড়ে। তাই কমিউনিস্টদের প্রতিহত করার জন্য তারা নাৎসিদের সাহায্য প্রার্থনা করে।
ইহুদি বিদ্বেষ
জার্মানরা ছিল টিউটন জাতিভুক্ত। তাই তারা জার্মানিতে বসবাসকারী ইহুদিদের সহ্য করতে পারত না। অধিকাংশ জার্মানবাসী তাদের দুরবস্থার জন্য ইহুদিরাই দায়ী বলে মনে করত। তাই নাৎসি দল জার্মানবাসীর মন বুঝে ইহুদি বিতারণকে তাদের অন্যতম কর্মসূচী বলে গ্রহণ করেন। নাৎসি দলের তরফে জার্মানি থেকে ইহুদি বিতরণ কর্মসূচি তাদের ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে।
নাৎসি দল গঠন
হিটলার অস্ট্রিয়ার একটি ছােটো শহরে জন্মালেও (১৮৮৯ খ্রি.) তেইশ বছর বয়সে মিউনিখে চলে আসেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ব্যাভেরিয়ার সেনাদলে করপােরাল হিসেবে লড়াই করে পুরস্কৃত হন। যুদ্ধ শেষে তিনি অ্যান্টন ড্রেক্সলার প্রতিষ্ঠিত জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি নামে মিউনিখের এক রক্ষণশীল জঙ্গি গােষ্ঠীতে নাম লেখান। পরে এই দলের নাম হয় ন্যাশনাল সােশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি (NSDAP, ১৯২০ খ্রি.) বা নাৎসি দল। হিটলার হলেন এই দলের সর্বময় কর্তা (ফুয়েরার)।
হিটলারের প্রভাব
জার্মানিতে নাৎসিবাদের উত্থানে হিটলারের সাংগঠনিক শক্তি, নেতৃত্ব দক্ষতা, বাগ্মিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। নিজের আত্মজীবনী ‘মেই ক্যাম্ফে’ জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার জার্মানবাসীকে হিটলারের প্রতি অনুরক্ত করে তােলে। তার জ্বালাময়ী ভাষণ জনমানসে নতুনভাবে উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল। পশ্চিমি রাষ্ট্রজোটের বিরুদ্ধে তার দুঃসাহসিক অভিযানের প্রস্তুতি নাৎসি দলকে জার্মানবাসীর কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। হিটলার সুকৌশলে মিত্রশক্তি, ভাইমার প্রজাতন্ত্র, বিত্তবান জার্মান সম্প্রদায়, সাম্যবাদী ও ইহুদিদের বিরােধিতা করে জার্মানবাসীর মন জয় করে নেন। ঐতিহাসিক অ্যালান বুলক তাই বলেছেন—হিটলার ছিলেন জনগণের আবেগ তৈরিতে ওস্তাদ।
হেরেনভক তত্ত্ব
নাৎসিবাদের প্রধান ভিত্তি ছিল উগ্র জাতীয়তাবাদ। হিটলার প্রচার করেছিলেন জার্মানরাই একমাত্র বিশুদ্ধ আর্য জাতির উত্তরাধিকারী। অন্যান্য সবজাতিই বর্ণসংকর। সুতরাং শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে জার্মানরা অন্যান্য বর্ণসংকর জাতির ওপর আধিপত্য কায়েম করার অধিকারী। এই তত্ত্ব ‘হেরেনভক তত্ত্ব’ নামে পরিচিত। এই তত্ত্বকে বাস্তবে প্রয়ােগ করে হিটলার ও তার নাৎসি দল প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
নাৎসি দলের ক্ষমতা দখল
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে নাৎসি দল ৬০৮টি আসনের মধ্যে ২৩০টি আসন পায়। প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ হিটলারকে সরকার গঠন করতে ডাকলে হিটলার প্রথমে এক বহুদলীয় সরকার গঠন করেন, কিন্তু তাতে শাসন পরিচালনায় বিভিন্ন অসুবিধা দেখা দিলে হিটলারের পরামর্শ মেনে, প্রেসিডেন্ট পুননির্বাচনের আদেশ দেন। ৫ মার্চের এই নির্বাচনে নাৎসি দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়ে জোট সরকার যােগ দেয়। জার্মান সংসদের এক বিশেষ আইন বলে হিটলার শাসন পরিচালনা ও আইন প্রণয়নের সর্বোচ্চ ক্ষমতা লাভ করেন। এই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েই রাষ্ট্রপতি হিন্ডেনবার্গ মারা যাওয়ার পর হিটলার নিজেকে ফুয়েরার ঘােষণা করে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণ করেন। হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানিতে নাৎসিবাদের উন্মেষ সম্পন্ন হয়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .