নারী শিক্ষার প্রকৃতি সংক্রান্ত বিতর্ক
নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ঊনবিংশ শতকে এদেশে আধুনিক নারীশিক্ষার প্রচলন হয়েছিল। ১৮৪৯ খ্রীষ্টাব্দে ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন, নারী শিক্ষার প্রচলন ও প্রসারের জন্য বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নারী-শিক্ষার প্রসারের জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রমুখ এদেশীয় সমাজ সংস্কারকরাও এই পর্বে তৎপর হয়েছিলেন কারণ নারীদের সাক্ষরতা গোটা সমাজের মুক্তি ঘটাবে এটা তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন। কিন্তু ঔপনিবেশিক আমলে ঊনবিংশ শতকে নারী সাক্ষরতা তথা নারী শিক্ষার প্রচলন ও প্রসার সীমাবদ্ধ ছিল শুধুমাত্র সমাজের উচ্চবর্গের মধ্যে।
নারীশিক্ষার ধারণা সমাজে প্রচলিত থাকলেও, নারী এবং পুরুষের জন্য পুরোপুরি অভিন্ন ধরনের শিক্ষার প্রচলন হয়নি। যেমন নারীদের মূলত সেইসব বিষয়েই শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে যা গৃহকর্মের পক্ষে অধিক উপযোগী। অন্যদিকে পুরুষদের সচরাচর সেই ধরনের শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে যা তাদের চাকুরি পাওয়ায় সুযোগ করে দেয়। আবার নারীরা সাধারণতঃ যে ধরনের শিক্ষা পান, তা অর্থনৈতিক স্বয়ংনির্ভরতা গড়ে তোলার পক্ষে অনেক ক্ষেত্রেই যথেষ্ট নয়। এছাড়া সব শিক্ষিত নারীরাই চাকরি অন্বেষণ করেন না, যাঁরা করেন—তাঁরাও যে সবাই মনোমত চাকরি পান—তাও নয়।
বস্তুতপক্ষে নারী-শিক্ষার আলোচনা প্রসঙ্গে লিঙ্গ বৈষম্যের চিত্রটি বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে এবং বিংশ শতকের গোড়ায় ভারতের সমাজ সংস্কারকরা ছাড়াও, এদেশে আগত খ্রীষ্টান মিশনারীরা, ভারতীয় মহিলা সংগঠনগুলি- এবং এদেশে আগত বেশ কয়েকজন পশ্চিমী মহিলা ভারতে নারী শিক্ষার প্রসারে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গিয়েছেন। কিন্তু কার্যতঃ শিক্ষার নামে নারীদের কাছে যে অঙ্গীকার রাখা হয়েছে—তা পুরুষদের প্রদত্ত শিক্ষার সাথে ঠিক সমধর্মী বা সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষা নয়, বরং নারীকে সেই ধরনের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যা তাকে ‘ভালো স্ত্রী’ এবং ‘আদর্শ মা’ হতে সাহায্য করবে। অধ্যাপক পার্শ্ব চট্টোপাধ্যায় মনে করেন যে, সাধারণভাবে প্রচলিত ধারণা ছিল এই যে, – নারীকে শিক্ষিত করা যেতে পারে, যদি ধরে নেওয়া হয়। সে শিক্ষিত হয়ে উঠে শালীনতা, ধার্মিকতা এবং গৃহকর্মনিপুণা হয়ে ওঠার মত গুণগুলি বজায় রাখবে এবং সেইমত শিষ্টাচারমূলক আচরণ করবে। এদেশে আধুনিক শিক্ষাবিস্তারের পর্বে দেখা গিয়েছিল যে, প্রথাগত কেতাবী শিক্ষা আধুনিক নারীদের পক্ষে যে শুধু উপযোগী হিসাবেই বিবেচ্য হতে শুরু করেছিল, তাই নয়, নারীদের ‘ভদ্র মহিলা’ হয়ে ওঠার পক্ষেও তা হয়ে উঠেছিল প্রায় অপরিহার্য। পুরুষরা শিক্ষিত হয়ে উঠে বহির্জগতের দায়দায়িত্ব সামলাবে, আর শিক্ষিত হয়ে উঠে মহিলারা আরও দক্ষতার সঙ্গে সেই সাথে সমতাল বজায় রেখে ঘর সংসার (অন্দরমহল) সামলাবে—এটাই স্বাভাবিক বলে প্রত্যাশা করা হত।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, মকিচাদের জন্য এরূপ স্বতন্ত্র ধরনের শিক্ষার কথা যে শুধু পুরুষ সংস্কারকরাই বলেছিলেন—তাই নয়, বহু ভারতীয় ও পশ্চিমী মহিলা সংগঠনেও বক্তব্য ছিল অনুরূপ। যেমন – ১৯২৭ খ্রীঃ গড়ে ওঠা অল ইন্ডিয়া উইমেন্স কনফারেন্স এর মত গুরুত্বপূর্ণ মহিলা সংগঠনও মনে করত যে, নারী শিক্ষার ধরন এমনটাই হওয়া উচিত যা নারীদের ‘আদর্শ স্ত্রী’ ও ‘আদর্শ মা’ হিসাবে গড়ে তুলবে। ভারতে আগত বহু পশ্চিমী মহিলা সংস্কারকের দৃষ্টিভঙ্গীতেই একই ধরনের বক্তব্য ও মতধারা লক্ষ্য করা যায়। তাঁরা মনে করতেন যে, পুরুষ এবং নারীর জন্য পৃথক ধরনের বক্তব্য ও মতধারা লক্ষ্য করা যায়। তাঁরা মনে করতেন যে, পুরুষ এবং নারীর জন্য পৃথক ধরনের সামাজিক ভূমিকা নির্দিষ্ট রয়েছে এবং তাই, তার সাথে সঙ্গতি বজায় রেখে পুরুষ ও নারীর শিক্ষাও স্বতন্ত্র ধরনের হওয়া প্রয়োজন। যেমন অ্যানি বেশান্ত মনে করতেন যে, এদেশে হিন্দুরা তাঁদের কন্যাদের স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষিত করে তুলতে ও সংগ্রাম করে জীবিকার্জনের জন্য বহির্জগতে পাঠাতে চান না। আশ্চর্যের বিষয় যে, তিনিই আবার বৈপরীত্যমূলকভাবে তাঁর স্বদেশ ব্রিটেনে নারীদের বিভিন্ন অধিকার ও পৈশাগত শিক্ষার দাবীর স্বপক্ষে সংগ্রামী আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন। অনুরূপভাবে মার্গারেট নোবেলও (যিনি ভগিনী নিবেদিতা নামে এদেশে সমধিক প্রসিদ্ধ।) এদেশের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য শিক্ষার ধারণাকে বর্জন করেছেন, এই যুক্তিতে যে এদেশীয় মেয়েরা আবহমানকাল ব্যাপী নিজেদের ‘সীতা’, ‘সাবিত্রী’র সাথে তুলনা করে নিজেদের গড়ে তুলতে অভ্যস্ত হয়েছে। যদিও পন্ডিতা রমাবাঈ প্রমুখ মাত্র কয়েকজন মুষ্টিমেয় নারী এদেশে লিঙ্গ নিরপেক্ষ ভাবে নারী-পুরুষের অভিন্ন শিক্ষার পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছিলেন, তবু মোটামুটিভাবে এবিষয়ে প্রথাগত রক্ষণশীল ভাবধারাই কার্যক্ষেত্রে স্থায়ী হয়েছিল।
তবে স্বাধীনতা উত্তরকালে এদেশে নারীদের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিতভাবেই বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু উদ্দেশ্যগত দিক থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য থেকেই গিয়েছে বলে মনে করেন গবেষক সাবা আগরওয়াল। তাঁর মতে, “এখনও এদেশে নারীদের অবস্থা প্রধানতঃ হয় বিবাহ এবং গৃহ ও গৃহস্থালির পরিপ্রেক্ষিতে, তারপরে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের ভিত্তিতে।” এই চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে নারীদের হার, মাঝখানে স্কুল যাওয়া ছেড়ে দেওয়া বা দিতে বাধ্য হওয়া, বিদ্যালয় শিক্ষা সম্পূর্ণ করা, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করা এবং নারীদের পাঠ্য বিষয় নির্বাচনের পরিসংখ্যানের মধ্যে। যেমন—বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দেখা যায় যে, অধিকাংশ নারীই কলাবিভাগকেই বেছে নেয়, পুরুষ শিক্ষার্থীরা অধিকাংশক্ষেত্রে বেছে নেয় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বা বাণিজ্য বিভাগকে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, যদিও সাম্প্রতিককালে বহুসংখ্যক মহিলা-চিকিৎসক, মহিলা-বিজ্ঞানী, মহিলা-বাণিজ্যিক পরামর্শদাত্রী তথা বিশেষজ্ঞা, মহিলা সাংবাদিকের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়, তথাপি একথা অনস্বীকার্য যে, তা কিন্তু মোটেই বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষাক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যের চিত্রকে যথাযথভাবে প্রতিফলিত করে না।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .