দাক্ষিণাত্যের হাঙ্গামার কারণ
১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দের দাক্ষিণাত্যে মহারাষ্ট্রে কুবি কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বিদ্রোহের দাবানল জ্বলে ওঠে তা দাক্ষিণাত্যের কৃষক বিদ্রোহ’নামে পরিচিত। সরকারী ভাষায় একে ‘দাক্ষিণাত্যের হাঙ্গামা’ বলা হয়েছে। এই বিদ্রোহের কতকগুলি কারণ ছিল।
১) খাজনার উচ্চহার
খাজনার উচ্চহার ছিল দাক্ষিণাত্যের কৃষক বিদ্রোহের মূল কারণ। রায়তােয়ারী বন্দোবস্ত ভূমিরাজস্বের পরিমাণ ছিল মােট উৎপাদনের ৪৫%-৫৫%। এর ফলে চাষীর হাতে গ্রামাচ্ছাদনের মতাে শশ্য থাকত না। এই উচ্চহারে রাজস্বের বিরুদ্ধে তারা ক্ষুব্ধ ছিল।
২) মহাজনদের শােষণ
অভাবের তাড়নায় মহাজনদের কাছ থেকে চাষীরা। ৩০%-৬০%সুদের বিনিময়ে টাকা,বীজধান ও খাদ্যশস্য ধার নিত। দাক্ষিণাত্য জুড়ে মহাজনি কারবার চালানাে গুজরাটি, মাড়ােয়ারি, লিঙ্গায়েত ও কুলকার্নি মহাজনদের শিকার ছিল অসহায় কৃষকরা।
৩) তুলাের মূল্য হ্রাস
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের জন্য মহারাষ্ট্রের তুলাের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ফলে তুলাে চাষীদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটে। কিন্তু গৃহযুদ্ধ মিটে গেলে আবার তুলাের চাহিদা হ্রাস পেল। ফলে কুনবিরা আবার নিক্ষিপ্ত হলাে হতাশা ও ঋণের গহ্বরে।
৪) অন্যান্য কারণ
উনবিংশ শতকের সাতের দশকে দক্ষিণ ভারতে এক চরম অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়; ক) অনাবৃষ্টি, অজন্মা সেখানকার কৃষক সমাজকে অসহায় করে তােলে, (খ) আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মন্দার সাথে। তাল রেখে ১৮৭০ খ্রিঃ থেকে কৃষি পণ্যের দাম কমতে শুরু করল। ফলে কৃষকদের অবস্থা শােচনীয় হয়ে ওঠে।(গ) ১৮৭১ খ্রিঃ রেলপথের প্রসার বন্ধ হয়ে গেলে শ্রমিকশ্রেণীর আয়ের একটা পথ বন্ধ হয়ে যায়। (ঘ) বােম্বাই সরকার জমির খাজনা প্রায় দেড়গুণ বৃদ্ধি করে যার ফলে কৃষকদের জমি নিলামে চড়লাে।
বিদ্রোহের সূচনা
এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে কৃষকদের বিদ্রোহ না করে উপায় রইলনা। ১৮৭৪ খ্রিঃ পুণার কাছে গ্রামে কালুরাম নামে এক মাড়ােয়ারি মহাজন বাবাসাহেব দেশমুখ নামে এক সম্ভ্রান্ত কৃষকের বাড়ি-জমি ঋণের দায়ে নিলামে ১৫০ টাকায় কেনায়। গ্রামবাসীরা কেংলিয়ার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ ঘটায়। কারণে গ্রাম থেকে এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে পুণা, পুরন্দরপুর, ইন্দাপুর আহম্মদনগরসহ প্রায় ৩৩টি গ্রামে।
এই বিদ্রোহের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্যণীয় –
১) বিদ্রোহী কৃষকরা মহাজনদের ঘরবাড়ি, দোকান, গুদাম প্রভৃতি লুঠ করত এবং এগুলিতে অগ্নিসংযােগ করত। মহাজনদের ওপর নানারকম নির্যাতন চালাতাে কিন্তু তাদের সাধারণভাবে হত্যা করত না। যার ফলে মাত্র ৫ জন মহাজনের প্রাণহানি ঘটেছিল।
২) বিদ্রোহী কৃষকদের মূল নজর ছিল ঋণপত্র, জমির দলিল ও হিসাবের খাতার দিকে। তারা এগুলিই ধ্বংস করত কারণ এগুলিই তাদের নিঃস্ব করে দিয়েছিল।
৩) বিদ্রোহী কৃষকদের মূল ক্রোধ ছিল মাড়ােয়ারীও গুজরাটি মহাজনদের বিরুদ্ধে এবং মূলতঃ তাদের বিরুদ্ধেই এই সংগ্রাম পরিচালিত হয়।
৪) এই বিদ্রোহ ব্রিটিশ বিরােধী আদর্শ দ্বারা পরিচালিত হয়নি।
দাক্ষিণাত্যের হাঙ্গামার ফলাফল
এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।
১) দাক্ষিণাত্য বিদ্রোহ কমিশন নিয়ােগ
দাক্ষিণাত্যের এই মহাজন বিরােধী কৃষক বিদ্রোহইংরেজ সরকার ও মহাজনদের সন্ত্রস্ত করে তােলে। বিদ্রোহের কারণ অনুসন্ধানের জন্য সরকার ১৮৭৬ খ্রিঃ ‘দাক্ষিণাত্য বিদ্রোহ কমিশন’ নিয়ােগ করে।
২) দাক্ষিণাত্য কৃষি সহায়কআইন প্রবর্তন
এই কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ১৮৭৯ খ্রিঃ দাক্ষিণাত্য কৃষি সহায়ক আইন প্রবর্তিত হয়।
৩) সুদের হার হ্রাস
মহাজনদে সুদের হার যুক্তিসম্মতভাবে কমানাের নির্দেশ দেওয়া হয়।
পরিশেষে বলা যায় – মহাজনরা দীর্ঘদিন পর গ্রামে ফিরেও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। ফলে দাক্ষিণাত্যের কৃষকরা বেশ কিছুদিন তাদের শােষণ ও উৎপীড়নের হাত থেকে রেহাই পেয়ে সাময়িক শান্তির জীবন ফিরে পেয়েছিল।
Comments ( 1 )
Assalamualai kum
Namaste 🙂