আধুনিক চিনের গণতান্ত্রিক লড়াই ছিল তাইপিং বিদ্রোহ। উনিশ শতকের মধ্যভাগে যেসব গণবিদ্রোহ চিনের অভ্যন্তরীণ ইতিহাসে প্রবাব ফেলেছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল তাই-পিং বিদ্রোহ (১৮৫০-১৮৬৪ খ্রিঃ)। তাই পিং’ শব্দটির অর্থ হল মহতী শান্তি। আরও ব্যাপক অর্থে – সামাজিক সমন্বয় (Great Social Harmony)। কালমার্কস তার রেভেলিউশানইন চায়না অ্যান্ড ইন ইউরােপ’ ‘Revolution in China and in Europe’ প্রবন্ধে লিখেছেন – ইংরেজ কামানের সাহায্য চিনের এপর আফিম নামক ঘুমের নেশার বস্তুর জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইলে এই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট রচিত হয়।
তাইপিং বিদ্রোহের কারণ
নানা কারণে তাই-পিং বিদ্রোহ সূচিত হয়েছিল –
1. মাঞচু সরকারের অপদার্থতা
অপদার্থ মাক্ষুশাসনে চিন সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত ছিল। সরকারের এই দুর্বলতার সুযােগে স্বার্থন্বেষী ইউরােপীয় শক্তিগুলি তখন চিনের বুকে নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা বিস্তারে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ঠিক এই সময়, চিনা জনসাধারণ মাঞচু শাসনের অবসান ও বিদেশি শক্তির শােষণের বিরুদ্ধে একপ্রবল বিদ্রোহ গড়ে তােলে।
2. ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার আহ্বান
তাই-পিং বিদ্রোহ রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করলেও প্রথমে কিনচু এটি ছিল একটি ধর্মীয় আন্দোলন। হাং-সিউ-চুয়ান নামে জনৈক পন্ডিত দক্ষিণ চিনের কোয়াং টুং প্রদেশে নিজেকে ‘স্বর্গীয় রাজ্য’রূপে ঘােষণা করেন। হাং-সিউ-চুয়ান মাঞ্চু বংশের জায়গায় তাই-পিং-রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে চিনে একটি মদ্ররাজ্য স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তাঁর প্রবর্তিত ধর্মের নাম হয় তাই-পিং-খ্রিস্টধর্ম। অল্পকালের মধ্যেই হাং-এর অনুগামীরা সংখ্যা বাড়ে ও তারা পরিকল্পনামতাে বিদ্রোহ ঘােষণা করে।
3. আর্থসামাজিক সংকট
দীর্ঘকাল চিনের আর্থসামাজিক কাঠামাে ছিল অপরিবর্তিত। জনসংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়লেও মাথাপিছু আবাদি জমির পরিমাণ বাড়েনি। দারিদ্রাক্লিষ্ট সাধারণ মানুষ মহাজনি ঋণের আবর্তে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়। তাই মুক্তির জন বিদ্রোহের ডাকে তারা স্বাভাবিকভাবেই সাড়া দেয়।
4. প্রশাসনিকদুর্নীতি
এই সময় চিনের প্রশাসন ছিল দায়িত্বজ্ঞানহীন ও দুর্নীতিগ্রস্ত। জনকল্যাণের কোনাে পরিকল্পনাই মা সরকার নেয়নি। অর্থের বিনিময়ে অযােগ্য ও অসৎ ব্যক্তিরা সরকারি পদ দখল করেছিল। প্রশাসনের প্রতি আস্থাহীন চিনা জনগণ তাই বিদ্রোহমুখী হয়।
5. কৃষক অসন্তোষ
বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা কৃষক বিক্ষোভগুলি ছিল সেসময় চিনের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। অথচ মা সরকার কারণ অনুসন্ধান বা প্রতিকারের কোনাে চেষ্টা না করেই কঠোর দমননীতি গ্রহণ করে। ফলে কৃষক অসন্তোষ ক্রমেই বেড়ে গিয়ে বিদ্রোহের রূপ নেয়।
6. প্রাকৃতিক বিপর্যয়
হােনান প্রদেশে খরা,হূপে ও কিয়াংসু প্রদেশে ইয়াংসি নদীর প্লাবন, কোয়াং-সি প্রদেশে দুর্ভিক্ষ, সানটুং অঞলে পীত নদীর গতি পরিবর্তন ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয় চিনাবাসীর মনােবল ভেঙে দেয়। ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের উদাসীনতা জনগণকে
বিদ্রোহমুখী করে তােলে।
7. সেনাবাহিনীতে অবক্ষয়
তৈনকি অবক্ষয় চিনা সেনাবাহিনীকেও স্পর্শ করেছিল। শারীরিক সক্ষমতার অভাব ও নৈতিক মানের অবনতি সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে তােলে। অপরদিকে মাঞবাহিনী থেকে কর্মচ্যুত সেনারা জীবিকার কারণে দস্যুবৃত্তি বেছে নেয়। ফলে চিনে ভয়ংকার বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এই সুযােগ গুপ্ত সমিতিরগুলি ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী চিনারা মাঞ্জুশাসন বিরােধী বিদ্রোহ ঘটায়।
8. অবশিল্পায়ন
চিনের গ্রামীণ অর্থনীতির মূল উৎস ছিল বস্ত্রশিল্প। কিন্তু প্রথম আফিম যুদ্ধে চিন পরাজিত হওয়ায় নানকিং চুক্তির শর্তানুসারে চিনের পাঁচটি বন্দর বিদেশিদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এত্র ফলে বিদেশি সুতিবস্ত্রে চিনের বাজার ছেয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই চিনে দেশীয় সুতিবস্ত্রের চাহিদা হ্রাস পায়। এবং হস্তশিল্পী ও কারিগররা বেকার হয়ে পড়ে। এরা ক্ষুদ্ধ হয়ে তাই-পিং বিদ্রোহে যােগ দেয়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .