চিনা সমাজের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো চিনের শহরাঞ্চলে বুর্জোয়াশ্রেণীর অনুপস্থিতি বুর্জোয়া শ্রেণীর পরিবর্তে এখানে জেন্ট্রি নামক একটি শ্রেণীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ষোড়শ সপ্তদশ শতকে ইংল্যান্ডে যে ‘জেন্ট্রি’ শ্রেণীর আবির্ভাব, তা ভূস্বামী শ্রেণীভুক্ত হলেও তার মধ্যে পুঁজিবাদী প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু চিনের সামন্ত সমাজে যে ‘জেন্ট্রি’ শ্রেণী দেখতে পাওয়া যায়, তা ছিল পুরোপুরি ভাবেই সামন্ত ভূস্বামীশ্রেণী, তার মধ্যে কোন পুঁজিবাদী প্রবণতা প্রাচীন যুগে থাকা ঐতিহাসিক কারণে সম্ভব ছিল না। চীনদেশের এই জেন্ট্রি শ্রেণী ছিল আক্ষরিক অর্থেই শাসক শ্রেণী। তারা একাধারে জমির মালিক, সরকারী পদে আশীন এবং কনফুসিয়াস শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন।
সাধারণ ভাবে বলতে গেলে, জেন্ট্রি (শেন-শি / Shen-Shih) শ্রেণীভুক্ত ব্যক্তিরা তারাই ছিলেন, যাঁরা কনফুসিয়র পরীক্ষায় পাশ করতেন। চিনা সমাজে তাঁদের গুরুত্ব ছিল সবচেয়ে বেশি, তাঁদের সুযোগ-সুবিধাও ছিল নানা ধরনের। জেন্ট্রিরাই কনফুসিয় মন্দিরে অনুষ্ঠিত সরকারী অনুষ্ঠানে যোগদানের এবং জনগোষ্ঠীর (clan) পূর্বপুরুষদের সুপ্রাচীন আচরণবিধি পালন করার অধিকারী ছিলেন, সাধারণ মানুষদের থেকে তাদের পোশাক পরিচ্ছদও ছিল আলাদা। জেন্ট্রি বহির্ভূত শ্রেণীর মানুষেরা যতই ধনী হোন না কেন, তাঁরা কখনই ‘শেন-শি’ দের মতো ক্ষমতা বা সুবিধার অধিকারী ছিলেন না। জেলাভিত্তিক পরীক্ষা পাশ করার পর তাঁরা ‘শেং-উয়ান’ (Sheng-yuan) নামে এবং উচ্চতর প্রাদেশিক ওমেট্রোপলিটান পরীক্ষা পাশের পর তাঁরা যথাক্রমে যেন (Chu-jen) ও চিন শি (Chin-She) নামে অভিহিত হতেন। প্রথম স্তরেরজেন্ট্রিদের মাথার টুপিতে রূপার বোতাম লাগানো থাকতো। আর উচ্চতর দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের মাথার টুপিতে সোনার বোতাম লাগানো থাকতো। সরকারী পদ লাভ করার পরে আরও নানা দামী ধাতুর তৈরী জিনিস তাঁদের অঙ্গে শোভা পেত।
জেন্ট্রিদের কেউ অপমান করতে পারত না, আর সরকারী অফিসাররাও তাঁদের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারত না। কোন জেন্ট্রি বহির্ভূত লোক জেন্ট্রিকে অপমান করলে তার শাস্তি সবসময়ই অন্য শ্রেণীভুক্ত ব্যক্তিদের একে অন্যকে অপমান করার শাস্তির তুলনায় অনেক বেশি হত। সাধারণ মানুষ আদালতে কখনই ‘শোন-শি’ কে সাক্ষী হিসাবে ডাকার অধিকারী ছিল না। শোন-শি-কে কখনই আদালতে ব্যক্তিগত ভাবে হাজিরা দিতে হত না, তার কোন ভৃত্যকে পাঠিয়ে দিলেই হত। শোন-শি কে কখনই আদালতে অপরাধ করলে ম্যাজিষ্ট্রেট তার বিচার করতে পারতেন না, উচ্চতর কর্তৃপক্ষ – শিক্ষা কমিশনারের সঙ্গে কথা বলতে হত। উচ্চতর কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শেন-শি থেকে পদচ্যুত করার পরেই ম্যাজিস্ট্রেট তাকে শাস্তি দিতে পারতেন।
জেন্ট্রি শ্রেণীর লোকেদের শ্রম করতে হত না, কারণ তাদের উনুন্নত সাংস্কৃতিক মান অনেক উচু ছিল। তারা শুধুই মানসিক শ্রম করতেন। তাদের মাথা পিছু কর (Poll tax) দিতে হত না, যাতে তাঁরা এ সব বিষয়ে চিন্তা করে সময় নষ্ট না করে অধ্যায়নের কাজে সময় দিতে পারেন এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উঁচু সরকারী চাকুরী করতে পারেন। ১২২৭ সালে যখন ভূমিকর ও মাথাপিছু কর মিশে যায়, তখন জেন্ট্রিরা অন্যদের তুলনায় কম পরিমাণ কর দিত। কর দেওয়ার ক্ষেত্রে তারতম্যের জন্য তাঁরা নিজেদের বাসভূমিকে ‘জু হু’ ‘শেন-হু’ বা ‘তা হু বলতেন আর সাধারণ বাসস্থান বা ছোট বাসস্থানকে বলতেন ‘মিন-হু’ বা ‘সিয়াও হু’, করের পরিমাণ তাঁদের ক্ষেত্রে অনদের তুলনায় অর্ধেকেরও কম ছিল।
আঞ্চলিক ক্ষেত্রে জেন্ট্রির দায়িত্ব ছিল ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের মধ্যেকার বিরোধে উভয়পক্ষকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মেটানো। জেন্ট্রিরা নিজেদের চিনের সুপ্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অভিভাবক হিসাবে মনে করতেন। কনফুসিয় নীতিকথা তাঁরা প্রচার করতেন। এবং বেসরকারী বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁরা আর্থিক সহায়তা করতেন। নীচুতলার মানুষদের বিক্ষোভ হলে, কৃষক বিদ্রোহ হলে তাঁরা ভাড়াটে বাহিনী তৈরী করে বিদ্রোহ দমনে নেতৃত্ব দিতেন সরকারের সঙ্গে। জনসাধারণের মধ্যে তঁরা সংযোগ রক্ষা করতেন। এই সমস্ত নানাবিধ কারণে জেন্ট্রি শ্রেণী ছিল চিনা সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণী। ইমানুয়েল স্যু চিনা রাষ্ট্রকে ‘জেন্ট্রি রাষ্ট্র’ হিসাবে অভিহিত করেছেন।
কিন্তু ক্ষমতা, জ্ঞান এবং জমির মালিক হওয়া সত্ত্বেও জেন্ট্রি শ্রেণীভুক্ত লোকেরা ব্যক্তিগতভাবে সকলে কিন্তু একই সঙ্গে এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন না। তাদের মধ্যে অনেক শিক্ষিত লোক ছিলেন যাঁরা কনফুসিয় পরীক্ষায় পাশ করতে পারেননি, আবার এমন অনেকে ছিলেন যঁরা পরীক্ষায় বসতেই চাননি। তাছাড়া এই শ্রেণীর মাত্র একটি ছোট অংশই প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দায়িত্বের অধিকারী ছিলেন। অন্যদিকে জমিই ছিল আর্থিক ক্ষমতার মূল উৎস। এই জমির মালিক সাধারণভাবে তাঁরাই হতেন যাঁরা কনফুসিয় ডিগ্রির এবং রাষ্ট্রীয় পদের অধিকারী। সেইসঙ্গে এটাও ঠিক যে, এমন অনেক ভূস্বামী ছিলেন যাঁদের কোন ডিগ্রি ছিল না এবং ডিগ্রিধারী স্কলার ছিলেন যাঁরা তুলনামূলকভাবে ছিলেন প্রায় নিঃস্ব। কিন্তু নিঃস্ব হলেও জেন্ট্রি সামাজিক শ্রেণীভুক্ত হওয়ার সুবাদে তাঁদের বিত্তবান হওয়ার অনেক সুযোগ ছিল।
জেন্ট্রিশ্রেণী ছিল প্রাচীন চিনের শাসক শ্রেণী, আর যেহেতু সামন্ত চিনের উপরিকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত আইনী ব্যবস্থাও সামন্তশ্রেণীর স্বার্থরক্ষা করতো, তাই শাসকশ্রেণী হিসাবে জেন্ট্রিও নানা ধরনের আইনী সুযোগসুবিধা ভোগ করতো। কোন অপরাধের জন্য আইন মোতাবেক যে শাস্তি অপরাধীর প্রাপ্য ছিল, জেন্ট্রিভুক্ত হওয়ার সুবাদে তাদের শাস্তির পরিমাণ অনেক কম হতো।
জেন্ট্রি পরিবারভুক্ত লোকেরা গ্রামে নয়, শহরে বসবাস করতেন। সেই শহরগুলি ছিল প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। শ্যেনোর মতে, নিরাপত্তার কারণেই শহরগুলি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা থাকতো। নিপীড়িত কৃষকদের বিদ্রোহ এবং বিদ্রোহী কৃষকদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে ভীত ভূস্বামী জেন্ট্রিরা নিরাপত্তা ঘেরাটোপে থাকতে বাধ্য হতো।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .