চিনে কমিউনিস্ট আন্দোলনের উদ্ভব ও বিকাশ
চিনা কমিউনিস্ট দলের প্রতিষ্ঠা
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রুশ বিপ্লবের সাফল্যের পর চীনা বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই মার্কসীয় দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হন। এই সময় পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লি-তাও-চাও, অধ্যাপক চেন-তু-শিউ এবং তাঁদের অন্যান্য সহকর্মীদের উদ্যোগে পিকিং, সাংহাই প্রভৃতি স্থানে মার্কসবাদী দর্শন আলোচনার জন্য পাঠচক্র গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে চীনের বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু কমিউনিস্ট গোষ্ঠী গঠিত হয়। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ১লা জুলাই সাংহাইয়ের এইসব বিভিন্ন গোষ্ঠীর এক কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। রুশ কমিউনিস্ট পার্টির পরামর্শ এবং পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই মার্কসবাদী অধ্যাপক লি-তা-চাও এবং চেন-তু-শিউয়ের উদ্যোগে এই সম্মেলনে চীনা কমিউনিস্ট দল প্রতিষ্ঠিত হয়। সূচনাপর্বে এই দলের তিনটি কর্মসূচী ছিল–
- চিনের রাষ্ট্রীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা
- চিনা সমরনায়কদের উচ্ছেদ এবং
- বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ।
কুয়োমিনটাং ও কমিউনিস্ট বিরোধ
ড. সান ইয়াৎ সেন তখন কুয়োমিনটাং দলের প্রধান এবং চিনা প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তিনি রুশ কমিউনিস্ট পার্টির পরামর্শ ও সাহায্যে কুয়োমিনটাং দলকে সুসংগঠিত করেন। তাঁর আমলে কমিউনিস্টরা কুয়োমিনটাং দলের সদস্য হতে পারত। এইভাবে দুই দল সংঘবদ্ধভাবে জাতীয় সমস্যার মোকাবিলা করত। কুয়োমিনটাং দলের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে কমিউনিস্টরা নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ড. সান ইয়াৎ-সেনের মৃত্যুর পর তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর চিয়াং কাই শেখ কুয়োমিনটাং দল ও সরকারের প্রধান হন। রাশিয়া ও চিনা কমিউনিস্টদের সহাযোগিতায় তিনি উত্তর চিনের সমরনায়কদের পরাজিত করে হ্যাংকাও, নানকিং প্রভৃতি অঞ্চল দখল করতে সক্ষম হন। পরে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি উত্তর চিনের রাজধানী পিকিং দখল করলে সমগ্র চিন ঐক্যবদ্ধ হয় এবং এই ঐক্যবদ্ধ চিনের রাজধানী হয় নানকিং। যাই হোক, কুয়োমিনটাং কমিউনিস্ট সহযোগিতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দ থেকেই নানা কারণে দুই দলে বিরোধ শুরু হয়। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে চিয়াং সাম্যবাদী রাশিয়ার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেন, কমিউনিস্টদের সব উচ্চপদ থেকে বিতাড়িত করা হয় এবং বহু কমিউনিস্টকে হত্যা করা হয়। ১৯২৭-২৯ খ্রিস্টাব্দে প্রায় ৪,৫০,০০০ কমিউনিস্ট প্রাণ হারায়।
কমিউনিস্টদের শক্তিবৃদ্ধি
এই অবস্থায় কমিউনিস্টরা শহর থেকে সরে গিয়ে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করে। তরুণ নেতা মাও-সে-তুং এবং চু-তে গ্রামের কৃষকদের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। মাও-সে-তুং প্রচার করেন যে, যেহেতু চিনে এখনও শিল্প বিপ্লব ঘটেনি বা শিল্প-শ্রমিকশ্রেণী গড়ে ওঠেনি, তাই চিনের ক্ষেত্রে কৃষকরাই সর্বহারা এবং তাদের দ্বারাই বিপ্লব ঘটবে। কিয়াং-সি প্রদেশে তাদের প্রধান ঘাঁটি স্থাপিত হয়। এছাড়া, ইয়াং-সি, হুনান, উত্তর ফুকিয়েন প্রভৃতি প্রদেশে কমিউনিস্টরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এইসব অঞ্চলে তারা জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করে কৃষকদের মধ্যে জমি বন্টন করে, কৃষি উন্নয়নের জন্য খাল খনন এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। মাও-সে-তুং ও চু-তে কৃষকদের নিয়ে কিয়াং সিতে ‘লাল ফৌজ’ গঠন করেন। এই অবস্থায় কমিউনিস্টদের দমনের জন্য চিয়াং সেনাবাহিনী পাঠান চিনে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।
এই গৃহযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে জাপান চিনের অধীনস্থ মাঞ্চুরিয়া দখল করে জোহাল পর্যন্ত অগ্রসর হয়। জাপানী আগ্রাসন প্রতিরোধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করে চিয়াং কমিউনিস্ট নিধনে অধিকতর সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি কমিউনিস্টদের প্রধান ঘাঁটি কিয়াং-সি অবরোধ করে তাদের ধ্বংস করার চেষ্টা করেন (১৯৩৪ খ্রিঃ)। এই অবস্থায় মাও-সে-তুংয়ের নেতৃত্বে পরিবার পরিজনসহ প্রায় এক লক্ষ কমিউনিস্ট সরকারি বাহিনীর অবরোধ ভেঙে ৬,০০০ মাইল পথ অতিক্রম করে দক্ষিণ চিন থেকে উত্তর-পশ্চিম চিনের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থান শেন্সি প্রদেশে উপস্থিত হয়। পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী, সরকারি বাহিনীর আক্রমণ এবং প্রবল দুঃখ দুর্দশা অতিক্রম করে ২৬৮ দিন পর ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে তারা তাদের গন্তব্যস্থানে পৌঁছয়। ইতিহাসে এই ঘটনা ‘লং মার্চ’ বা ‘দীর্ঘ যাত্রা’ নামে পরিচিত। এই ঘটনার ফলে একদিকে যেমন মাও-সে-তুং কমিউনিস্টদের স্বীকৃত নেতায় পরিণত হন, তেমনি এই বিশাল পথপরিক্রমা তাদের শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, সহিষ্ণুতা ও ধৈর্যের শিক্ষা দেয়।
সিয়াং-ফু ঘটনা
মাও-সে-তুং শেন্সি প্রদেশে একটি প্রায় -স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর রাজধানী হয় সিয়াং ফু কমিউনিস্টদের দমনের জন্য চিয়াং সেখানে সেনাবাহিনী পাঠান। এই সময় কমিউনিস্টরা চাইছিল। কুয়োমিনটাংদের সঙ্গে যৌথভাবে জাপানী আক্রমনের মোকাবিলা করতে। চিয়াং তাদের আবেদনে কোন সাড়া দেননি। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিয়াং ফুতে এলে চ্যাং-শিউ-লিয়াং নামে তাঁর জনৈক সেনাপতি তাঁকে অপহরণ করে পনেরো দিন আটকে রাখে। রুশ হস্তক্ষেপে তিনি মুক্তি পান এবং কমিউনিস্টদের সঙ্গে যৌথভাবে জাপানী আক্রমণের মোকাবিলায় সম্মত হন। এই ঘটনা ‘সিয়াং ফু ঘটনা’ নামে খ্যাত।
মাও-সে-তুং ও চিনা প্রজাতন্ত্র
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে জাপান আবার চিনের ওপর আক্রমণ শুরু করে এবং চিনের বহু স্থান দখল করে নেয়। এই সময় কুয়োমিনটাং ও কমিউনিস্টরা যৌথভাবে জাপানী আক্রমণ প্রতিরোধ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও এই ঐক্য বজায় ছিল। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে জাপান আত্মসমর্পণ করলে দুই দলের যুদ্ধকালীন সমঝোতা বিনষ্ট হয় এবং দুই দল আবার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। মাও-সে তুং এর নেতৃত্বে কমিউনিস্টরা একের পর এক চিনের বিভিন্ন ভূখন্ড দখল করতে থাকে। দুই দলে প্রবল সংঘর্ষ শুরু হয়। চিয়াং ও তাঁর অনুগামীরা যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ফরমোজা বা তাইওয়ান দ্বীপে, আশ্রয় গ্রহণ করে সেখানে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। অপরপক্ষে, ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১ লা অক্টোবর মাও-সে-তুং এর নেতৃত্বে পিকিং এ ‘জনগণের প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়। মাও-সে-তুং এই প্রজাতন্ত্রের প্রথম চেয়ারম্যান বা সভাপতি এবং চৌ-এন-লাই প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।
তাৎপর্য
১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে মাও-সে-তুং এর নেতৃত্বে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় শক্তি হিসেবে নয়া চিনের অভ্যুদয় আধুনিক ইতিহাসে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই বিপ্লব চিনা জনগণ ও বিশ্ববাসীর কাছে নতুন বার্তা পৌঁছে দেয়। চীনা জনগণকে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ফলে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত সামন্ততন্ত্র ও পুঁজিবাদ শাসিত চিনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রমাণিত হয় যে, জনগণই হল শেষ কথা । ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১ লা অক্টোবর কমিউনিস্ট চিনের প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষ্যে এক ভাষণে মাও সে-তুং বলেন যে, চিনের মানুষ আর কখনও দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হবে না বা কোন প্রকার বিদেশী হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করবে না। সাম্যবাদী শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে চিনের ইতিহাসে এক যুগের সমাপ্তি ঘটনা – শুরু হল এক নতুন যুগের, যে যুগের ইতিহাস হল সমাজতন্ত্রের পথে অগ্রগতির ইতিহাস।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .