চিনের মুক্তদ্বার নীতি
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ সচিব জন হে চিনে মুক্তদ্বার নীতির উদ্ভাবক, তথাপি, একদল ঐতিহাসিক মনে করেন এই নীতির প্রকৃত উদ্ভবাবক গ্রেট ব্রিটেন। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ‘“হে ডক্ট্রিন” (Hay Doctrine) এর মাধ্যমে এই নীতিকে কার্যকর করেছিল মাত্র। ব্রিটেনের প্রথম থেকেই আশঙ্কা ছিল যে, ঔপনিবেশিক বিভাজন সম্পন্ন হলে চীনের সর্বত্র সে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমান অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। সব থেকে শিল্পোন্নত দেশ হিসাবে ব্রিটেন স্বাভাবিকভাবেই চেয়েছিল শিল্পজাত পণ্যের বাজারে সমানাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিযোগিতামূলক বাণিজ্যে লিপ্ত হতে। কিন্তু অন্যান্য বিদেশি শক্তির “প্রভাবাধীন অঞ্চলে” এ ধরনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিযোগিতা সম্ভব ছিল না। তাই চিন বিভিন্ন শক্তির “প্রভাবাধীন অঞ্চলে” বিভাজিত হোক— তা ব্রিটেন কখনোই চায়নি। কারণ সে জানত তা হবে তা বাণিজ্যিক স্বার্থের পরিপন্থী। বিশেষত, রাশিয়ার আগ্রাসী নীতি ব্রিটেনকে সবথেকে বেশি আতঙ্কিত করেছিল। মারিয়াতে রুশ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু রাশিয়ার আগ্রাসী নীতিকে বাধা দেবার ক্ষমতা সে মুহূর্তে ব্রিটেনের ছিল না। একদিকে চিনের প্রতিবেশী হবার সুবাদে রাশিয়া কতকগুলি সুবিধা ভোগ করত। অন্যদিকে, ইউরোপের দুই বৃহৎ শক্তি – ফ্রান্স ও জার্মানি রাশিয়ার আগ্রাসী নীতিকে মদত দিয়েছিল। তাই ব্রিটেন চেয়েছিল চিনে যেন বিভিন্ন শক্তির “প্রভাবাধীন অঞ্চল” গড়ে না ওঠে। আর যদি এ ধরনের অঞ্চল গড়েও ওঠে, তবে সমস্ত বিদেশি রাষ্ট্রই যেন সেখানে বাণিজ্য করার সমান অধিকার লাভ করে। এই নীতিই মুক্তদ্বার নীতি নামে বিখ্যাত। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে ও ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ব্রিটেন এ বিষয়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যৌথ প্রচেষ্টার প্রস্তাব দেয়। পিকিং এ নিযুক্ত মার্কিন মন্ত্রী চার্লস ডেনবি এবং গ্রেট ব্রিটেনের মার্কিন রাষ্ট্রদূত জন হে এই প্রস্তাব সমর্থন করেন কিন্তু তৎকালীন মার্কিন বিদেশ সচিব জন শেরম্যান এই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। কিছু দিনের মধ্যেই জন হে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ সচিব নিযুক্ত হন এবং চিনে “মুক্তদ্বার নীতি”র কথা ঘোষণা করেন।
কোন্ পরিস্থিতিতে কূটনৈতিক কৌশল হিসাবে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এই “মুক্তদ্বার নীতি” ঘোষণা করেছিল তা আগেই আলোচিত হয়েছে। তাছাড়া, হিপসিলি নামে চীনের শুল্ক বিভাগের এক উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারী এ বিষয়ে জন হে-কে প্রভাবিত করেছিলেন। হিপসিলির বক্তব্য ছিল, বিভিন্ন শক্তিবর্গের “প্রভাবাধীন অঞ্চলে” সংশ্লিষ্ট শক্তিগুলি যদি মূলধন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিঞ্চিৎ সুবিধা পায় তাতে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু বাণিজ্যে সমানাধিকার বিঘ্নিত হলে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিদেশি বণিকদের ক্ষেত্রে শুল্কহারে কোন বৈষম্য অবলম্বন করা চলবে না। রকহিল নামে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে এক প্রবীণ অফিসার ছিলেন, যিনি চিন, তিব্বত ও মঙ্গোলিয়ায় দীর্ঘদিন কাজ করেছিলেন। জন হে হিপসিলির চিন্তাধারার উপর ভিত্তি করে রকহিলের একটি স্মারকপত্র রচনা করার নির্দেশ দেন। এই স্মারকপত্রই Hay Doctrine নামে বিখ্যাত। এই স্মারক পত্র আমেরিকার রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ করে।
হে-র স্মারকপত্রে নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলি রাখা হয়েছিল – (১) প্রভাবাধীন অঞ্চলের স্থানীয় শাসনব্যবস্থায় বিদেশি হস্তক্ষেপ চলবে না, (২) চিনের উন্মুক্ত বন্দরগুলিকে চিনের শুল্ক বিভাগ চুক্তি অনুযায়ী কর আদায় করবে এবং এ বিষয়ে কোনো বিদেশি হস্তক্ষেপ থাকবে না। (৩) নিজ নিজ ‘প্রভাবাধীন অঞ্চলে” কোনো বিদেশি শক্তি অন্য কোনো দেশের বাণিজ্যিক পণ্যের ওপর বৈষম্যমূলক শুল্ক চাপাবে না। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে জুলাই মাসে হে তাঁর দ্বিতীয় স্মারকপত্র প্রকাশ করেন। প্রথমটির সাথে দ্বিতীয় স্মারকপত্রের বেশকিছু তফাত পরিলক্ষিত হয়। প্রথম স্মারকপত্রে বাণিজ্যিক স্বার্থের সমতার কথাই বলা হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয়টিতে বাণিজ্যিক সমানাধিকার ছাড়াও চিনের আঞ্চলিক অখন্ডতা ও স্বাধীনতা রক্ষার বিষয়টির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, চিনের শাসনতান্ত্রিক সংহতি রক্ষা করা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে একান্ত কাম্য।
অনেকেই মনে করেন যে, ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে চিন যখন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের শিকার হয়েছিল এবং বৃহৎ শক্তিবর্গের দ্বারা চিন ব্যবচ্ছেদ আসন্ন হয়ে উঠেছিল, সেই সময় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সময়োচিত হস্তক্ষেপের ফলে “মুক্তদ্বার নীতি”র মাধ্যমে চিনের আঞ্চলিক অখন্ডতা রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু ঐতিহাসিক জাঁ শ্যেনো এই বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেছেন যে, হে-র স্মারকপত্রে চিনে বিভিন্ন শক্তির “প্রভাবাধীন অঞ্চল” রাখার বিষয়টি বা চীনের সার্বভৌমতায় হস্তক্ষেপ করার বিষয়টির ওপর কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি এবং এই স্মারকপত্র কখনোই চিন সরকারকে দেখানো হয়নি। তিনি বলেছেন যে, চিন থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশে ভাগ বসানোর তাগিদেই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র “মুক্তদ্বার নীতি” গ্রহণ করেছিল।
আমেরিকান ঐতিহাসিক ওয়েন ল্যাটিমোর (Owen Lattimore) রসিকতা করে “মুক্তদ্বার নীতি” কে “আমিও নীতি” (Me too Policy) বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইস্রায়েল এপ্স্টেইন বলেছেন –
যুক্তরাষ্ট্রের সরকার উপলব্ধি করেছিল যে, “মুক্তদ্বার নীতি” গৃহীত হলে আমেরিকান বণিকরা সমগ্র চিন জুড়ে বাণিজ্য চালানোর ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হবে না। চিন নিজে “মুক্তদ্বার নীতি” চায় কিনা, এ বিষয়ে কিন্তু চিনের কোনো পরামর্শ চাওয়া হয়নি। যেহেতু সেই সময় কোনো শক্তির পক্ষেই এককভাবে সমগ্র চিন সাম্রাজ্য দখল করে নেওয়া সম্ভব ছিল না এবং প্রত্যেকটি শক্তিই একে অপরের দ্বারা চিন থেকে উচ্ছেদ হওয়ার আশঙ্কায় আশঙ্কিত ছিল, তাই “মুক্তদ্বার নীতি” মেনে নেওয়ার বিষয়ে কেউই বিশেষ আপত্তি দেখায়নি। বৃহৎ শক্তিবর্গ, বিশেষত, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন, চিনের যাবতীয় “প্রভাবাধীন অঞ্চল” এবং “ইজারা স্বত্বাধীন এলাকা” সকলের জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত রাখতে চেয়েছিল। জাঁ শ্যেনোকে অনুসরণ করে বলা যেতে পারে যে, “মুক্তদ্বার নীতি” ছিল চিনে বিদেশীদের যৌথ কর্তৃত্বের পারস্পরিক নিশ্চয়তা।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .