চরমপন্থার উদ্ভবের পটভূমি
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের চরমপন্থী নেতৃবৃন্দের ইংরেজ সরকারের প্রতি ‘ভিক্ষাবৃত্তি নীতি এবং সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ সরকারের শােষণ ও নিপীড়নের প্রতিক্রিয়ায় কংগ্রেসের যুব শক্তির মধ্যে একধরনের প্রতিবাদী মানসিকতার সৃষ্টি করেছিল, যাকে বলা হয়েছে চরমপন্থীবাদ’। পাশ্চাত্ত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাবের ফলে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির যে অস্তিত্ব বিলােপের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল–তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানসিকতা গড়ে উঠেছিল। অর্থাৎ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে ‘Indian National Identity-কে রক্ষা করার প্রবণতা থেকেই চরমপন্থী মানসিকতা গড়ে উঠেছিল।
মূলত সর্ব ব্যাপারে প্রতিরােধ বা বিরােধিতাই ছিল চরমপন্থীদের মূলমন্ত্র। তাঁরা ছিলেন কর্মে ও নীতিতে যুগপৎ চরমপন্থী। এঁরা নির্ভীক, ভাব ও ভাষায় প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ ও যুক্তিবাদী মনের অধিকারী ছিলেন। এঁরা বিদেশি সংস্কৃতির মধ্যে আত্মার লুপ্তি, বিদেশি সাম্রাজ্যের অঙ্গীভূত হওয়া ও ভারতীয়ত্বের বিলুপ্তির প্রচেষ্টাকে মেনে নিতে পারেননি। মহারাষ্ট্রের তিলক, বাংলার বিপিনচন্দ্র পাল ও অরবিন্দ, পাঞ্জাবের লালা লাজপৎ রায় প্রমুখ সকল চরমপন্থীদের মধ্যেই লক্ষ করা যায় ভারতীয় ইতিহাসের প্রতি গভীর অনুরাগ ও শ্রদ্ধা, বেদ-বেদান্ত, গীতা ও শক্তি এবং ভক্তিবর্ম প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও আকর্ষণ। চরমপন্থীগণ গ্রাম্য স্বত্তশাসন ব্যবস্থার সমর্থক ছিলেন এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।
এধরনের একই সঙ্গে বৈপ্লবিক মনােভাব ও ধর্মীয় অনুরাগের সমন্বয় পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। আয়ারল্যান্ডের কেটিক পুনরভ্যুত্থান, রাশিয়ার শ্লোভােফিল আন্দোলন ও চিনের জাতীয় আন্দোলনই কেবলমাত্র এর সাথে তুলনীয়। রক্ষণশীল। হলেও এরা চূড়ান্ত গোঁড়া ছিলেন না। তিলক হিন্দুধর্মের পুনরভ্যুত্থানের জন্য ততটা আগ্রহী ছিলেন না, কিন্তু ধর্মীয় চেতনার মাধ্যমে এর নিহিত শক্তি দ্বারা তিনি হিন্দু তথা ভারতের জনগণের ঐক্য স্থাপন করতে এবং দেশত্মবােধে উদ্বুদ্ধ করতে সচেষ্ট ছিলেন। ১৮৯৩ সালে ল্যান্সডাউন কিম্বার্লির সেক্রেটারি অফ্ স্টেটকে এক চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন যে—এভাবেই এক জড় নির্বোধ সমাজ প্রকৃত রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
চরমপন্থীরা ব্যক্তি স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে মুখ্য বলে গণ্য করতেন এবং তাদের মত ছিল যে, স্বাধীনতা ছাড়া সামাজিক বিবর্তন কখনই সম্ভব পর নয়। তাই চরমপন্থীগণ আপাত দৃষ্টিতে যে সকল ধর্মীয় আদর্শ প্রচার এবং ধর্মীয় প্রতীক গ্রহণ করেছিলেন, তাতে তাদের ধর্মীয় পুনরুত্থানকারীদের সমকক্ষ মনে করলে ভুল হবে। দেশপ্রেম ছিল তাদের ধর্ম, আর জাতি ছিল তাদের উপাস্য দেবী। বঙ্কিমচন্দ্র, অরবিন্দ ছিলেন এই মন্ত্রের পুরােহিত এবং বিবেকানন্দ ছিলেন বিশ্বব্যাপী প্রচারক। চরমপন্থীরা পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের সাথে স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবনে যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন। তারা চেয়েছিলেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনগণ নতুন আশা, আকাঙ্ক্ষা ও সচেতনতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশমাতৃকার বেদীমূলে আত্মােৎসর্গের প্রেরণায় সাধারণত দুঃখ কষ্টকে উপেক্ষা করে মুক্তি বা স্বাধীনতার জন্য এগিয়ে আসবে।
জনগণের স্বাধীনতার জন্য এগিয়ে আসার পেছনে আর একটি বড়াে কারণ ছিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও পরিবেশ। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ শাসন ও শােষণে ভারতীয়দের মনে বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছিল। কিন্তু জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের নরমপন্থী গােষ্ঠীর ইংরেজদের প্রতি নরমপন্থী মনােভাব কংগ্রেসের অন্য গােষ্ঠী অর্থাৎ চরমপন্থী গােষ্ঠী গড়ে উঠতে পরােক্ষভাবে সাহায্য করেছিল। সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের জন্য নরমপন্থীদের ব্যর্থতা যাকে বিপান চন্দ্র বলেছেন যে, নরমপন্থীগণ ব্রিটিশদের ‘Credit side দেখতে গিয়ে ‘Dedit side-কে উপেক্ষা করে বসেছিলেন। যার ফলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। ঐতিহাসিক অনিল শীলের মতে, নরমপন্থীগণ ছিলেন উচ্চ মধ্যবিত্ত জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। এরা কর্তাভজা ধামাধরা’ নীতি নিয়ে ইংরেজ সরকারের কাছে শাসন সংস্কারের জন্য আবেদন-নিবেদন জানিয়ে বিফল হয়েছেন। নরমপন্থীদের এই ভিক্ষাবৃত্তিকে বিপিনচন্দ্র পাল ব্যঙ্গ করেছিলেন এই বলে- “They want re-Sorms, not reforms.” এছাড়া নরমপন্থীদের সাথে জনগণের যােগাযােগ ছিল বিচ্ছিন্ন এবং তাদের ভিক্ষাবৃত্তি জাতির মনে বিরূপতা সৃষ্টি করেছিল। সুমিত সরকারের মতে কংগ্রেসের মধ্যে একটা উৎসাহের অভাব দেখা দিয়েছিল। উনিশ শতকের শেষ কয়েক বছরে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কংগ্রেসের মধ্যে নতুন আলােড়ন এল কার্জনের বঙ্গভঙ্গ ও অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল নীতির বিরুদ্ধে। স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলন চরমপন্থীদের কাছে স্বরাজ লাভের নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিল। ১৯০৭ সালে সুরাট কংগ্রেসে নরমপন্থীদের সাথে চরমপন্থীদের চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘটল। অর্থাৎ ইংরেজ বিরােধী উদ্দীপনায় পিছিয়ে পড়ল নরমপন্থীরা। তিলক, বিপিন পাল, এবং লালা লাজপৎ রায়-এর নেতৃত্বে কংগ্রেসে চরমপন্থী গােষ্ঠী আত্মপ্রকাশ করল। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিরােজ মেহতা ও গােখলের বিরােধিতা চরমপন্থীদের আরও স্পষ্ট ও তীব্রতর করে তুলেছিল। এর সূত্রপাত ঘটল ১৯০৬ সালে কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশনে চরমপন্থীরা ৯ বৎসরের জন্য কংগ্রেস বয়কট করল।
উপরিউক্ত বিষয়গুলি ছাড়াও ইংরেজ সরকারের বৈষম্যমূলক অর্থনীতি, বাণিজ্য নীতি, শােষণ ও নিপীড়ন প্রচন্ড ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল ভারতীয়দের মধ্যে। ১৮৯৪ ও ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের শুল্ক ও কার্পাস আইন ভারতের বস্ত্রশিল্পের প্রচন্ড ক্ষতি করেছিল। ১৮৯৬-১৯০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দুর্ভিক্ষে প্রায় ১০ লক্ষ ভারতবাসী মারা গিয়েছিল। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্রের প্লেগে ইংরেজ সরকারের ভূমিকা ও ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ নীতি ভারতীয়দের ক্ষোভকে বিক্ষোভে পরিণত করেছিল। রমেশচন্দ্র দত্ত, দাদাভাই নৌরাজী প্রমুখ দেখিয়েছেন কীভাবে ইংরেজ শাসনে ভারতবাসী আরও দরিদ্র হয়ে যাচ্ছিল এবং কৃষকরা কর-ভারে জর্জরিত হয়ে পড়েছিল। এই সব ঘটনা চরমপন্থী আন্দোলন গড়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। এছাড়া আবিসিনিয়ার হাতে ইতালির পরাজয়, আইরিশ স্বাধীনতা সংগ্রাম, জাপানিদের হাতে বিরাট দেশ রাশিয়ার পরাজয়, ইয়ং তুর্কী আন্দোলন, ১৯০৫-এর রুশ বিদ্রোহ প্রভৃতি বিচিত্র আন্তর্জাতিক ঘটনা চরমপন্থীদের মানসিক শক্তি জুগিয়েছিল প্রবল ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে।
কিন্তু কেম্ব্রিজ ঐতিহাসিকরা চরমপন্থী গােষ্ঠীর উত্থানের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে ক্ষমতা দখলের বিরােধকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু সুমিত সরকার, অমলেশ ত্রিপাঠি প্রমুখ কেম্ব্রিজ ঐতিহাসিকদের মতের বিরােধিতা করেছেন। তাঁরা বলেন, কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে আদর্শগত বিরােধ থাকলেও ক্ষমতা দখলের বিরােধ ছিল না। মূলত নরমপন্থীদের ‘Mendicancy Policy-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবেই চরমপন্থা মতবাদের উদ্ভব হয়েছিল।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .