গণতন্ত্রের অর্থ
প্রাচীন গ্রিসে খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে ‘গণতন্ত্র’ শব্দটির প্রথম প্রয়োগ ঘটে। ‘ডিমস্'(Demos) এবং ‘ক্রেটোজ’ (Kratos) এই দুটি গ্রিক শব্দ নিয়ে ‘ডেমোক্রেসি (Democracy) শব্দের উদ্ভব হয়। ‘ডিমস্’ শব্দটির মানে হল ‘জনগণ’ আর ‘ক্লেটোজ’ শব্দটির মানে হল কর্তৃত্ব বা শাসন। এককথায় ‘গণতন্ত্র’ বা (Democracy) শব্দটির অর্থ হল জনগণের শাসন।
ব্যাপক ও সংকীর্ণ অর্থে গণতন্ত্র
সাধারণভাবে ‘গণতন্ত্র’ সংকীর্ণ ও ব্যাপক এই দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়। ব্যাপক অর্থে গণতন্ত্র বলতে এমন এক আদর্শ সমাজব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাম্য প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। আবার সংকীর্ণ অর্থে গণতন্ত্র বলতে বোঝায় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বা গণতান্ত্রিক সরকার (Democratic Government)। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বা সরকার বলতে জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থাকে বোঝায়। প্রাচীন গ্রিসের ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্রগুলিতে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। আধুনিককালে রাষ্ট্রের পরিধি ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বদলে পরোক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রচলিত হয়েছে। এক্ষেত্রে নাগরিকদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম সম্পাদন করেন।
আব্রাহম লিংকন প্রদত্ত সংজ্ঞা এবং তার ব্যাখ্যা
প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকন গণতন্ত্রের একটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা নির্দেশ করেছিলেন। লিংকনের মতে, গণতন্ত্র হল জনগণের দ্বারা জনগণের জন্য জনগণের শাসন (“Government of the people, by the people and for the people”)।
মার্কসবাদীদের অভিমত
গণতন্ত্র বলতে মার্কসীয় তত্ত্বে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে শ্রেণিহীন শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা না হলে গণতন্ত্র কখনোই বাস্তবায়িত হতে পারে না। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যগুলিকে বাস্তবে রূপায়িত করতে সক্ষম।
ডাইসি ও ব্রাইসের বক্তব্য
অধ্যাপক ডাইসি এবং লর্ড ব্রাইসের মতো আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা লিংকনের দেওয়া সংজ্ঞার মতো গণতন্ত্রকে এত সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। লিংকনের সংজ্ঞায় গণতন্ত্রকে ‘জনগণের জন্য’ এবং ‘জনগণের দ্বারা’ শাসন বলে অভিহিত করা হয়েছে। ‘জনগণের শাসন’ বলতে সরাসরি জনগণের নিজেদের শাসন, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের শাসন, সমগ্র জনগণের শাসন-তিনটির যে-কোনো একটি অবস্থাকেই বোঝানো হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সমস্ত জনগণের শাসনকার্য পরিচালনায় অংশগ্রহণের বিষয়টি সম্পূর্ণ অবাস্তব। এই কারণে ডাইসি জনগণের অধিকাংশের শাসন পরিচালনায় অংশগ্রহণকে গণতন্ত্র বলে অ্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনই (Majority rule) হল গণতন্ত্র। এই কারণে লর্ড ব্রাইস মন্তব্য করেছেন, জনগণের সকলের হাতে শাসনক্ষমতা থাকলেও গণতন্ত্র আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন।
সাম্প্রতিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অভিমত
সাম্প্রতিককালে কার্ল পপার, রবার্ট ডাল, জোসেফ সুমপিটার প্রমুখ ভিন্ন দৃষ্টিতে গণতন্ত্রের অত্যাধুনিক অর্থ ব্যাখ্যা করেছেন। কার্ল পপারের মতে গণতন্ত্র হল এমন কতকগুলি প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে জনগণ শাসকদের নিয়ন্ত্রণ এমনকি প্রয়োজনে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে। জনগণ এখানে শাসকদের মতের বিরুদ্ধে বিনা বলপ্রয়োগে সংস্কারের প্রস্তাব কার্যকর করতে পারেন। সামপিটারের মতে গণতন্ত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা নীতি নির্ধারণের ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকে না, গণতন্ত্রে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এসব কাজ সম্পাদন করেন। তাই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থাই হল গণতন্ত্র। রবার্ট ডাল নানা স্বার্থগোষ্ঠীর মধ্যে সমঝোতার একটি প্রক্রিয়া হিসাবে গণতন্ত্রকে চিহ্নিত করেছেন।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .