ভারতে থুকিডিডিস বা হেরােডােটাসের মতাে প্রাচীন ঐতিহাসিক ও তাদের রচিত ঐতিহাসিক গ্রন্থ না থাকায় তৎকালীন বিভিন্ন তথ্যগুলিতে বিশ্লেষণ ও পরস্পরের সমন্নয় সাধন করে ইতিহাস রচনার উপজীব্য খুঁজে বার করতে হয়। এই তথ্যগুলিকেই ঐতিহাসিক উপাদান বলা হয়। যেমন—প্রাচীন সাহিত্য, মুদ্রা, শিলালিপি, স্থাপত্য, ভাস্কর্য প্রভৃতি থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি।
প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার অপ্রতুলতার কারণে আমাদের তৎকালীন শিলালিপি, মুদ্রা, থাপত্য, বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষগুলি খনন করে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। খনন দ্বারা প্রাপ্ত এই সকল উপাদান, প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান নামে পরিচিত।
শিলালিপির গুরুত্ব
প্রাচীন রাজাগণ তাদের শাসনকাল সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় তামা, লোহা, রুপা, ব্রোঞ্জ, পাথর বা মাটির ফলকে লিখে রাখতেন। এগুলি শিলালিপি নামে পরিচিত। এগুলি থেকে রাজার নাম, বংশাবলি, সময়কাল, সাম্রাজ্য বিস্তার, ধর্মবিশ্বাস, প্রশাসন, ব্যক্তিগতগুণাবলি ও অন্যান্য বিষয়গুলি সম্পর্কে জানা যায়। আবার তৎকালীন সমাজ, ব্যাবসাবাণিজ্য, ভূমিব্যবস্থা সম্পর্কেও শিলালিপিগুলি থেকে জানা যায়। মৌর্যযুগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় সম্রাট অশােকের শিলালিপি ও অনুশাসনগুলি থেকে।
শিলালিপিতে বিভিন্ন ভাষা ব্যবহার করা হয়। পালি, ব্রাহ্মী, খরােষ্ঠী, সংস্কৃত, তেলেগু, মালয়ালাম, প্রভৃতি ভাষায় প্রাপ্ত প্রধান কয়েকটি শিলালিপি হল সমুদ্রগুপ্তের এলাহবাদ প্রশস্তি’, চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর ‘আইহােল প্রশস্তি’, কলিঙ্গরাজ খারবেলের ‘হাতিগুম্ফা গুহালেখ’, গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর নাসিক প্রশস্তি’, শশাঙ্কের ‘গঞ্জাম লিপি’, শকক্ষত্রাপ রুদ্রদামনের ‘জুনাগড় প্রশস্তি’ প্রভৃতি। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস চর্চায় শিলালিপির গুরুত্ব স্বীকার করে তাই ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন—“Inscriptions, have proved a source of the highest value for re-construction of the political history of ancient India.
মুদ্রার গুরুত্ব
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় মুদ্রার ভূমিকা অপরিসীম। মুদ্রাগুলি সােনা, রূপা, তামা, সিসা প্রভৃতি ধাতু দিয়ে তৈরি হত এবং এই সব মুদ্রায় সংস্কৃত, ব্রাক্ষ্মী প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন লিপি খােদাই করা হত। মুদ্রা থেকে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়।
প্রথমত, মুদ্রায় খােদাই করা লিপি থেকে রাজার নাম, সময়কাল ও বৈভব, সাম্রাজ্য সীমা সম্পর্কে জানা যায়।
দ্বিতীয়ত, মুদ্রায় ধাতুর ব্যবহার থেকে তৎকালীন অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।
তৃতীয়ত, মুদ্রার লিপি ও ছাপ থেকে প্রচলিত ভাষা, ধর্ম, শিল্পরীতি সম্পর্কে জানা যায় (প্রথম চন্দ্রগুপ্তের মুদ্রা)
চতুর্থত, মুদ্রায় ব্যবহৃত ছবি থেকে, রাজাদের ব্যক্তিগত জীবন ও অভিরুচি সম্পর্কে জানা যায়। (সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রা)। মুদ্রা না থাকলে গ্রিক, শক, কুষাণ বা পার্থেনিয়ানদের ইতিহাস চর্চা সম্ভব হত না।
স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পের গুরুত্ব
প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ, প্রাসাদ, দুর্গ, মন্দির, বিহার চৈত্য, স্তুপ, দেবদেবীর মূর্তি, মৃৎপাত্র ও অন্যান্য প্রত্নবস্তু থেকে প্রাচীনভারতের অনেক অজানা ইতিহাস জানা যায়। সিন্ধু সভ্যতার, ধ্বংসাবশেষ, সারনাথের বিহার, অজন্তা ও ইলােরার গুহাচিত্র এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এছাড়া পাটলীপুত্র, তক্ষশিলা, নালন্দা, মথুরা, তাম্রলিপ্ত, হস্তিনাপুর, গৌড়, বেলুচিস্তান প্রভৃতি স্থান থেকে প্রচুর প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপত্য নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলি থেকে মৌর্য, গুপ্ত, চোল, পল্লব প্রভৃতি শাসনকালের শিল্পকলা, স্থাপত্যরীতি, ভাস্কর্য শিল্প। সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। পাশাপাশি নগর ও প্রাসাদের ধবংসাবশেষ থেকে বাস্তুশিল্প, সামাজিক জীবন, রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনীতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়। অশােকস্তম্ভগুলি যেমন শিল্প ও ভাস্কর্যের ঐতিহ্য বহন করে তেমনই ভাষা ও ধর্মসম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য প্রদান করে। আবার ভারতের বাইরে বেলুচিস্তান ও তুর্কিস্তানের খননকার্য থেকে ভারতীয় সভ্যতার সঙ্গে গ্রিক, পারসিক ও অন্যান্য সভ্যতার গভীর সম্পর্কের কথা জানা যায়।
সাহিত্যিক উপাদান
আর্যদের সময় থেকে সাধারণত ভারতের ইতিহাসে উপাদানের প্রাচুর্য লক্ষ করা যায়। সাহিত্যিক উপাদানকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায় দেশীয় সাহিত্য ও বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ। দেশীয় সাহিত্য ও প্রাচীন ভারতে বিভিন্ন পর্যায়ে একাধিক গ্রন্থ রচিত হয়। এগুলিকে দেশীয় সাহিত্য বলা হয়। দেশীয় সাহিত্য বিষয়ভিত্তিকভাবে দুই প্রকার—ধর্মীয় সাহিত্য ও ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য।
ধর্মীয় সাহিত্য
হিন্দুধর্মকে কেন্দ্র করে প্রাচীন ভারতে যে সকল গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। তার মধ্যে বেদ, পূরাণ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, ব্রাত্মণ, আরণ্যক, স্মৃতিশাস্ত্র প্রভৃতি প্রধান। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থ ত্রিপটক জাতক, মহাবংশ, দীপবংশ, জৈনকল্পসূত্র, ভাগবতীসূত্র ইত্যাদি গ্রন্থও ধর্মগ্রন্থের অন্তর্গত। এই গ্রন্থগুলি থেকে তৎকালীন ভারতের ধর্মীয় ব্যবস্থা সমাজ, অর্থনৈতিক বিন্যাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণালাভ করা যায়।
ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য
ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যগুলি বিভিন্ন উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছিল। অনেকগুলি রচনা জীবনী আকারে পাওয়া যায়। এর মধ্যে বানভট্টের ‘হর্ষচরিত’, অশ্বঘােষের ‘বুদ্ধচরিত’, সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’, বিহনের ‘ বিক্রমাঙ্কদেব চরিত প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। এই গ্রন্থগুলি থেকে হর্ষবর্ধন, রামপাল, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত প্রমুখ শাসকের শাসন কাল সম্পর্কে জানা জায়।
ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যের একটি বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন পণ্ডিতের লেখা অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, আইন, ব্যকরণ, বিজ্ঞান, প্রভৃতি বিষয়ক গ্রন্থ। এগুলির মধ্যে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, পানিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’, পতঞ্জলীর ‘মহাভাষ্য, বিশাখাদত্তের মুদ্রারাক্ষস’ নাটক, নাগার্জুনের ‘মাধ্যমিকা সংহিতা’, শুদ্রকের রচিত গ্রন্থ প্রভৃতি উল্লেখ যােগ্য। আলির ক্ষেত্রেও বেশ কিছু গ্রন্থ রচিত হয়। কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’ থেকে কাশ্মীরের ইতিহাস, রাজশেখর রচিত প্রবন্ধ কোশ’ প্রভৃতি থেকে গুজরাটের ইতিহাস জানা জায়।
বৈদেশিক বিররণ
প্রাচীনভারতে বিভিন্ন সময়ে আসা বিদেশি সাহিত্যিক ও পর্যটকদের বিবরণী থেকেও ভারত সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যায়। মেগাস্থিনিস রচিত ইন্ডিকা’, প্লিনি রচিত প্রাকৃতিক ইতিহাস’, টলেমি রচিত ‘ভূগােল’, প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য।
এছাড়াও কুইন্টাস, কার্টিয়াস, প্লুটার্ক প্রমুখের রচনা, জনৈক অজ্ঞাত মিশরীয় নাবিকের লেখা ‘পেরিপ্লাস অফ দি এরিথ্রিয়ান সী’ নামক গ্রন্থটি থেকে ভারতের ভৌগােলিক অবস্থা, ইতিহাস, বন্দর ও বাণিজ্য, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয়ে জানা যায়। চিনা পর্যটক ফা-হিয়েনের ‘ফু-কিউ-কি ও হিউয়েন সাঙ রচিত ‘সি-ইউ-কি গ্রন্থ দুটি থেকে ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম বিকাশের পাশাপাশি গুপ্তযুগ ও হর্ষবর্ধনের শাসনকাল সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানা যায়।
সীমাবদ্ধতা
প্রাচীনভারতীয় গ্রন্থগুলি কখনােই ঐতিহাসিক গ্রন্থরূপে রচিত হয়নি। তাছাড়া ধর্মীয় সাহিত্য ও ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমন অনেক বর্ণনা দেয় যা বিশ্বাস যােগ্য নয়। এমনকি বৈদেশিক বিবরণীতে এমন অনেক উল্লেখ পাওয়া যায় যার সঙ্গে ভারতীয় সমাজ বা সংস্কৃতির কোনাে সম্পর্ক ছিল না বলেই প্রমাণিত হয়েছে। তাছাড়া অনেক রচনা সভাকবিদের দ্বারা রচিত হওয়ায় বিভিন্ন শাসকের শাসনকালের প্রকৃত চিত্র না পাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। এই সমস্ত কারণে লিখিত উপাদানগুলিকে যত্নসহকারে বিশ্লেষণ করা হয় এবং অন্যান্য উপাদানগুলির নিরীখে সভ্যতা যাচাই করা হয়। এরূপ। সীমাবদ্ধতা স্বত্ত্বেও সাহিত্যিক উপাদানের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .