আধুনিক যুগে নারী শিক্ষা
অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত ইসলামিক শিক্ষা, দুর্বলতর প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি গ্রামীণ সমাজে কিছু কিছু আঞ্চলিক প্রয়োজন ভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। কিন্তু মোগল শাসনব্যবস্থা ক্রমশ শিথিল হয়ে পড়ার দরুন আঞ্চলিক শাসনকর্তারা অত্যাচারী ও শোষক হিসাবে ধীরে ধীরে স্বৈরাচারী হয়ে উঠলেন। শিক্ষার কোনও বিকাশ এই অবস্থায় হওয়া ছিল অসম্ভব। সেজন্য অনেক ঐতিহাসিকের মতে ভারতীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে ১৬০০ খ্রিঃ থেকে আধুনিক যুগের সূত্রপাত। কারণ সেই সময় ভারতে “ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি”র আগমন হয়। তার হাত ধরেই আসে খ্রিস্টান মিশনারিরা। এদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় জনসাধারণের ধর্মান্তরিতকরণ এবং খ্রিস্টধর্মের প্রচার করার জন্য শিক্ষাকেই এরা প্রধান মাধ্যম রূপে বেছে নিয়েছিলেন। নারী শিক্ষার ক্ষেত্রেও মিশনারিদের অবদান কম নয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান লক্ষ্য ছিল ব্যাবসায়িক স্বার্থে ক্ষমতা দখল। ভারতে নিজেদের শাসন দৃঢ় করার কাজ সম্পন্ন হতেই এরা শাসনের প্রয়োজনেই শিক্ষিত সম্প্রদায় তৈরি করার দিকে নজর দিলেন। নারী শিক্ষার প্রসঙ্গ ছিল তাদের কাছে অবহেলিত। পরবর্তী কালে মিশনারিরা নানা জায়গায় শুধু মেয়েদের পড়ার জন্য বিদ্যালয় গড়েছিলেন। প্রথমদিকে এই উদ্যোগ একেবারেই ব্যক্তিগত ও বেসরকারি পর্যায়ে ছিল। পরবর্তী পর্যায়ে দেখা গেল সরকার এ ব্যাপারে কিছু কিছু আর্থিক সাহায্য দান করে নারী শিক্ষার প্রসারে উৎসাহ দান করতে এগিয়ে এসেছে।
এরপর আমরা আরো দেখতে পাই যে মিশনারিরা ছাড়াও বেশ কিছু ভারতীয় এবং বিদেশি বিদ্যেৎসাহী ব্যক্তি নারীশিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন এবং নানা বেসরকারি প্রচেষ্টার মাধ্যমে দেশে নারী শিক্ষার বিস্তারের চেষ্টা করেন। নব জাগরণের সময় আমরা বেশ কিছু ভারতীয়কে এই প্রচেষ্টায় সামিল হতে দেখতে পাই। যেমন বাংলায় রাজা রামমোহন রায়, জিরোজিও, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাধাকান্ত দেব ইত্যাদি। গোঁড়ামির আবরণ ভাঙতে এগিয়ে আসেন আগরকর, রাণাডে, দাদাভাই নাওরোজি, জগন্নাথ শঙ্কর শেঠ এবং অন্যরা।
১৯০১ খ্রিঃ মহিলাদের সাক্ষরতার হার ছিল ০.৭%, যেখানে পুরুষদের হার ছিল ১০%। ১৯৩৭ খ্রিঃ সেই হার গিয়ে দাঁড়াল মহিলাদের ক্ষেত্রে ৩%। নারী শিক্ষায় ভারতীয়দের অংশগ্রহণের জন্য একটি সামাজিক পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল। সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে এবং বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও আইন প্রণয়ন পরোক্ষভাবে মেয়েদের সামাজিক উন্নয়ন সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির সহায়ক হয়েছিল এবং সেই সঙ্গে নারী শিক্ষার চাহিদা বৃদ্ধিতেও সাহায্য করেছিল। ১৯৪৭ খ্রিঃ, স্বাধীনতার সময় নারী শিক্ষার হার গিয়ে দাঁড়াল ১৬% তে।
বর্তমানে আমরা দেখতে পাই যে আমাদের ভারতের সংবিধানে পুরুষ ও নারীদের সম-অধিকারের কথা বলা রয়েছে। শুধু সাংবিধানিক স্বীকৃতিই নয় সরকার বিভিন্ন সময়ে নানা আইন প্রণয়ন এবং আদেশ জারির মাধ্যমে নারীদের সামাজিক মর্যাদা আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে। নারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা ক্ষমতায়ন করতে নারীদের সমস্যার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দান করেছে। এর ফলে যদিও শহরাঞ্চলে নারীর অবস্থানের এবং শিক্ষার সুযোগে যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছে, কিন্তু গ্রামাঞ্চলে এখনও মেয়েদের অবস্থা যথেষ্টই করুণ। অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েদের এখনো প্রথাগত শিক্ষাদান করাকে বিলাসিতা ভাবা হয়। সংসারে ছেলে এবং মেয়ের প্রতি আচরণের বৈষম্যের কারণে মেয়েদের বোঝা ভাবা হয় এবং তাকে পরমুখাপেক্ষী, আর্থিক এবং শিক্ষাগত ভাবে পরনির্ভর করে রাখা হয়। তবে, শহরে এবং আর্থসামাজিকভাবে এগিয়ে থাকা পরিবারে এবং অঞ্চলগুলিতে পরিস্থিতি একটু আশার আলো দেখায়। যদিও সমগ্র দেশের পরিস্থিতি আশানুরূপ নারীভ্রুণ, কন্যাসন্তান হত্যা এখনও অবাধে ঘটতে দেখা যায়। এর থেকেই বোঝা যায় যে নারী বহু পরিবারে এবং সামগ্রিকভাবে সমাজে অবাঞ্ছিত। তার মূল অন্যতম কারণ অবশ্যই অশিক্ষা। উপযুক্ত শিক্ষাই একমাত্র ফেরাতে পারবে নারীর মর্যাদা।
২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী আমরা দেখি যে ভারতবর্ষে সাক্ষরতার হার ৬৫% এবং পশ্চিমবাংলায় সাক্ষরতার হার ৬৮.৮৪%। বর্তমানে সারা ভারতে নারী সাক্ষরতার হার ৫৪% এবং পশ্চিমবাংলায় সেটি ৫৯.৬১%। পুরুষ সাক্ষরতার হার সেই তুলনায় সারা ভারতে ৭৫% এবং পশ্চিমবাংলায় ৭৭.২%। অর্থাৎ এখানেও যথেষ্ট লিঙ্গ বৈষম্য দেখা যাচ্ছে শিক্ষার ক্ষেত্রে। এই বৈষম্যই সমাজে মেয়েদের পিছিয়ে থাকার জোরালো প্রমাণ।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .